কুরআনের আলো
সূরা আল-মুমতাহিনা: ১-৬ (পর্ব-১)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাশরের আলোচনা শেষ করেছিলাম। আজ আমরা এর পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা মুমতাহিনার সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন শুরু করব। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরাটিতে ১৩টি আয়াত রয়েছে। এই সূরার আয়াতগুলোতে মূলত আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে মুমিনদের জন্য নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমেই এই সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُمْ مِنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنْتُمْ وَمَنْ يَفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ (1) إِنْ يَثْقَفُوكُمْ يَكُونُوا لَكُمْ أَعْدَاءً وَيَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ وَأَلْسِنَتَهُمْ بِالسُّوءِ وَوَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ (2)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শক্ৰকে বন্ধুরূপে গ্ৰহণ করো না, তোমরা কি তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা প্রেরণ করছ, অথচ তারা, তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা রাসূলকে এবং তোমাদেরকে [মক্কা থেকে] বহিস্কার করেছে এ কারণে যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর উপর ঈমান এনেছ। যদি তোমরা আমার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে এবং আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য [নিজ ঘরবাড়ি থেকে] বের হয়ে থাক, তবে কেন তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছ? আর তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্ৰকাশ কর তা আমি সম্যক অবগত। তোমাদের মধ্যে যে কেউ এরূপ করে সে নিঃসন্দেহে সরল পথে থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।” (৬০:১)
“তোমাদেরকে কাবু করতে পারলে তারা হবে তোমাদের [ঘোর] শত্রু এবং হাত ও জিহ্বা দ্বারা তোমাদের অনিষ্ট সাধন করবে, আর তারা কামনা করে তোমরা যেন কাফের হয়ে যাও।” (৬০:২)
রাসূলুল্লাহ (সা.) যতদিন মক্কায় ছিলেন ততদিন মক্কার মুশরিকরা মুসলমানদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে তাদের ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করত। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেন। মুশরিকদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে মুসলমানরাও দলে দলে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যান।
হিজরতের পরও মক্কার মুশরিকরা কয়েক দফায় মদীনায় হামলা চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের মিথ্যা ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু মক্কার কাফেররা এই ষড়যন্ত্রে বিজয়ী হতে পারেনি। অষ্টম হিজরিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা শহরকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করতে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ওই নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সংকল্প করেন।
একজন মুসলমান যার পরিবার তখনও মক্কায় বসবাস করত তিনি রাসূলে খোদার এই সিদ্ধান্তের কথা গোপনে চিঠিতে লিখে একজন নারীর হাতে মক্কায় পাঠালেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত জিব্রাইল আমিনের মাধ্যমে এই খবর বিশ্বনবীকে জানিয়ে দিলেন। মহানবী (সা.) চিঠির লেখককে ডেকে পাঠালেন এবং কয়েকজনকে পাঠালেন মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়া নারীর কাছ থেকে চিঠিটি ফেরত আনার জন্য। তারা পথিমধ্যে ওই নারীকে ধরতে পারেন এবং তার কাছ থেকে চিঠিটি ফেরত নিয়ে আসেন।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে সূরা মুমতাহিনার এসব আয়াত নাজিল হয়। এখানে আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের মানুষকে ভর্ৎসনা করে বলছেন, মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে মুসলমানদের গোপন খবর তাদের কাছে পৌঁছে দিও না। তোমরা হয়তো ভেবেছো, কাফিররা তোমাদেরকে বন্ধু ভাবছে। অথচ এসব কাফির মুখ দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলে এবং তারা যদি তোমাদের পরাভূত করতে পারে তাহলে তোমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- একজন মানুষের পক্ষে পরস্পরবিরোধী দু’টি পক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে বন্ধুত্বের একই সময়ে আল্লাহর দ্বীনের শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতেই পারে না।
২- ধর্ম থেকে রাজনীতি আলাদা নয়। একটি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রনীতি এমন হওয়া উচিত যেখানে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা ছিন্ন করার মাপকাঠি হবে ধর্ম।
৩- ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পরিণতি মুমিনের জন্য কল্যাণকর হয় না। এক সময় সে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
এবারে সূরা মুমতাহিনার ৩ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
لَنْ تَنْفَعَكُمْ أَرْحَامُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَفْصِلُ بَيْنَكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (3)
“তোমাদের আত্মীয়-স্বজন ও [কাফির] সন্তান-সন্ততি কিয়ামতের দিন কোন উপকার করতে পারবে না। [সেদিন] আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন; আর তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।” (৬০:৩)
আগের আয়াতুগলোর ব্যাখ্যায় আমরা বলেছি যে, মদীনার কোনো কোনো মুহাজিরের পরিবার ও আত্মীয় স্বজন মক্কায় থেকে যাওয়ায় তাদেরকে কফিরদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য কাফিরদের কাছে মুসলমানদের গোপন খবর পৌঁছে দিতেন। সেই আলোচনার ধারবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হচ্ছে, যে সন্তান সন্ততি ঈমান আনেনি তারা পার্থিব জগতে আল্লাহর ক্রোধ থেকে তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। কিয়ামতের দিনও তাদেরকে তোমাদের থেকে আলাদা করে ফেলা হবে এবং জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। কাজেই এ ধরনের সন্তান সন্ততির জন্য তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামি করো না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আমাদের জীবনে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে ধর্মীয় বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে, সন্তানের স্নেহবাৎসল্যে আমরা যেন ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে দূরে সরে না যাই।
২- কাফিরদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে এবং তাদের ওপর ভরসা করা যাবে না যদি তারা যদি আমাদের আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিও হয়।
এবারে সূরা মুমতাহিনার ৪ থেকে ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ (4) رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا وَاغْفِرْ لَنَا رَبَّنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (5) لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيهِمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَمَنْ يَتَوَلَّ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (6)
“নিশ্চিয়ই ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি; এবং আমাদের- তোমাদের মাঝে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন [ততক্ষণ পর্যন্ত]। তবে স্বীয় পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিটি ব্যতিক্রম: ‘আমি অবশ্যই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোন অধিকার রাখি না।’ হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা আপনার ওপরই ভরসা করি, আপনারই অভিমুখী হই আর প্রত্যাবর্তন তো আপনারই কাছে।” (৬০:৪)
“হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে পরীক্ষা [এবং কাফিরদের উৎপীড়নের] পাত্র বানাবেন না। হে আমাদের রব, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”(৬০:৫)
“নিশ্চয় তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রত্যাশা করে, আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, [সে জেনে রাখুক] নিশ্চয় আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।”(৬০:৬)
পবিত্র কুরআনের একটি শিক্ষণীয় পদ্ধতি হচ্ছে মানবজাতির সামনে অনুকরণীয় আদর্শ তুলে ধরা। মানুষের কাছে আল্লাহ তায়ালার বাণী পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি নবী-রাসূলদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল নিজেদের আচার আচরণ ও কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষের সামনে সর্বোত্তম অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করা। তাদের দায়িত্ব ছিল তারা আল্লাহর যে বাণী মানুষের সামনে তুলে ধরছেন নিজেদের জীবনে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান নির্বিশেষে সব বড় ধর্মের জাতির পিতা। এই আয়াতগুলোতে তাঁকে আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ইব্রাহিম হলেন এমন এক আদর্শ যাকে সকল যুগের সকল মুমিন মুসলমানকে অনুসরণ করতে হবে। অবশ্য হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার পিতাকে অর্থাৎ যিনি তাকে লালন পালন করেছিলেন তাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি যদি ঈমান আনেন তাহলে তার গুনাহ মাফের জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। কিন্তু তিনিও যখন ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানান তখন হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।