পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা- (পর্ব-৮)
'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক অনুষ্ঠানের গত পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা চারপক্ষীয় সহযোগিতা বাস্তবায়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সামরিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার আমরা জ্বালানি ক্ষেত্রে এ দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বিস্তারের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলবো।
যে পথটি পণ্য পরিবহন ও চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং জাতীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্য পরিবহন ও স্থানান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হিসাবে বিবেচিত হয় তাকে করিডোর বলে। আন্তর্জাতিক করিডোর হল আন্তর্জাতিক পরিবহন নেটওয়ার্ক যেখানে রেললাইন, রাস্তা এবং জলপথগুলি আন্তর্জাতিক ট্রানজিট এবং পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। করিডোরগুলোর রুট এমন যাতে পণ্য পরিবহন লাভজনক হয়। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগের পুরনো পথ এবং করিডোরগুলোর মধ্যে একটি হল চীনা সিল্ক রোড। অতীতে, সিল্ক রোড চীন থেকে মধ্য এশিয়া, ইরান, তুরস্ক, বলকান এবং ইউরোপ পর্যন্ত গিয়েছিল, কিন্তু "ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড" প্রকল্পে বা নিউ সিল্ক রোড মধ্য এশিয়ার আরো অনেক অংশ, ইরান, পশ্চিম এশিয়া, রাশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাকে পরিবহন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত করা হবে যার মধ্যে ৭০ টিরও বেশি দেশ রয়েছে। 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প' বাস্তবায়নে চীনকে সহযোগিতার প্রধান অংশীদার হলো ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান।
বিশেষ করে, পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায়, ইউরোপে চীনের পন্য প্রবেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সড়ক পরিবহন এবং জ্বালানি অবকাঠামো রয়েছে ইরানে। ইরান নর্থ-সাউথ করিডোর, ECO প্রকল্প বাস্তবায়নসহ পারস্য উপসাগরকে কৃষ্ণ সাগরের সাথে সংযোগকারী বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ট্রানজিট করিডোরে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, উত্তর-দক্ষিণ করিডোর ইরানের মাধ্যমে বৃহত অর্থনীতির দেশ ভারতকেও রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করেছে। এই করিডোরটি একটি বহুমুখী করিডোর যা সমুদ্র, স্থল এবং রেলপথকে সংযুক্ত করেছে। এই করিডোরের উৎপত্তিস্থল ভারতের বোম্বাইয়ের বাণিজ্যিক বন্দর। ভারত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য জাহাজ ইরানের দক্ষিণে বন্দর আব্বাসে পৌঁছবে এবং সেখানে তাদের মালামাল খালাস করবে। এরপর ভারতের এসব পণ্য অল্প খরচ এবং স্বল্প সময়ে ইউরোপ ও রাশিয়ার দেশগুলোতে পৌঁছে যাবে।
ইরানের শুষ্ক অঞ্চল দিয়ে পণ্য পরিনহনের জন্য মহাসড়ক এবং রেলপথ দুটিই ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
ইরানের দক্ষিণের বাণিজ্যিক বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে তা এই দুটি পথ দিয়ে ইরানের উত্তরে আনজালি বন্দরে পৌঁছায় এবং সেখান থেকে বাণিজ্যিক পণ্য আবার জাহাজে করে রাশিয়ার "আস্ট্রাখান" বন্দরে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখান থেকে আবার রেলপথে কিংবা সড়কপথে মস্কো পৌঁছায়। অন্য রুটের তুলনায় ইরানের এই রুট অনেক লাভজনক। যোগাযোগা ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর-দক্ষিণ করিডোরকে মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত দেশগুলোর পরিবহন খরচ এবং নিরাপত্তার দিক থেকে যোগাযোগের সবচেয়ে সাশ্রয়ী মাধ্যম। কারণ ইরানের যোগাযোগের পথগুলো পারস্য উপসাগর ও ওমান সাগরের মাধ্যমে সর্বনিম্ন খরচে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তাসহ তাদের পণ্য আমদানি ও রপ্তানি প্রদান করতে পারে এবং মধ্যএশিয়ার স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর সমস্যাগুলো কমিয়ে আনতে পারে। যদি উত্তর-দক্ষিণ করিডোরটি সম্পন্ন হয় এবং রেলপথ সংযুক্ত হয়, তাহলে আশা করা যায় যে ভারতের সাথে ইউরোপের বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এই করিডোরের রুটে অবস্থিত সমস্ত দেশ এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
ওয়াশিংটনের মিডলইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক অ্যালেক্স ওয়াতানখাহ এ সম্পর্কে লিখেছেন, উত্তর-দক্ষিণ করিডোর এবং পূর্ব-পশ্চিম করিডোরের গুরুত্ব বিবেচনা করে, রাশিয়ার "লাগান" শহরের কাছে একটি নতুন বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যা ১৬০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মান করা হবে। এটি সম্পন্ন হলে রাশিয়া, ইরান ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
অন্যদিকে, চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে। দীর্ঘকাল ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পূর্ব-পশ্চিমের সংযোগ সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। উন্মুক্ত জল ও সাগর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে সবসময়ই প্রতিযোগিতা বজায় ছিল যাতে সমুদ্র ও সমুদ্রগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী প্রণালীগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্য শক্তির ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ অবস্থায় চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প বিশ্বজুড়ে ব্যবসা জাণিজ্যের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিল্ক রোডের একটি কৌশলগত পরিবহন রুট হচ্ছে রেলপথ। চীনা রেলপথটি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে তুর্কমেনিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য দিয়ে ইরানে প্রবেশ করবে এবং ইরান হয়ে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগর এলাকায় পৌঁছবে। এই রেলপথটি আসলে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের অংশ। এ ছাড়া, এই রেললাইন পশ্চিম চীনকে ইউরেশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের সাথেও সংযুক্ত করবে এবং এই পথের আবার শাখা উপ-শাখা রয়েছে, যার সাথে আশেপাশের অনেক দেশের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। এই পথে পণ্য পরিবহনে সাত থেকে আট দিন সময় লাগবে যা কিনা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যাইহোক, চীন-ইরান-ইউরোপকে নিয়ে রেললাইন একটি বিশাল প্রকল্প এবং চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের একটি উপসেট, যাকে বলা হয় চীন, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরানের 5-দেশের রেলপথ। এটি তুরস্কের সাথে সংযোগ অব্যাহত রাখে এবং অবশেষে সমগ্র অঞ্চলটিকে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করে।
ইরান ১৯৭০ এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে গ্যাস রপ্তানি শুরু করে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর উদ্ধৃত্ত গ্যাস অন্যান্য দেশেও রপ্তানির উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৪ সাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের জন্য আলোচনা শুরু হয় যা শেষ করতে পনের বছর সময় লেগেছিল যা কিনা 'শান্তির পাইপলাইন' নামে পরিচিত। ইরানের দক্ষিণ পার্স গ্যাস ফিল্ডে গ্যাসের বিশাল খনি আবিস্কৃতি হওয়ার পর ইরান চীনসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিশাল অঞ্চলে গ্যাস রপ্তানির উদ্যোগ নেয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা এবং পাশ্চাত্যের বাধার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।