আগস্ট ০১, ২০২৩ ১৪:৫২ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো:

তুলা ধুনা হবে দই-স্যুপের মতো। চমৎকার একটা ব্যঞ্জনা আছে এই প্রবাদে। ওই ব্যঞ্জনার রহস্য উন্মোচন করতে হলে পুরো গল্প শুনতে হবে। গল্পটি এরকম: খুব বেশি প্রাচীনকালের কথা নয়। যখন থেকে মানুষ তুলা দিয়ে লেপ-তোশক-বালিশ বানানোর কাজ শুরু করেছে এবং এগুলো ব্যবহার করতে শিখেছে তখনকার কথা। 

কোনো একটি জিনিসের প্রচলন শুরু হলে স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে তার চাহিদা বাড়ে। ওই চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় নতুন পেশা বা বৃত্তিরও। তুলা দিয়ে বালিশ-তোশক বানানোর প্রথা শুরুর সাথে তাই তুলা ধুনার পেশারও প্রচলন দেখা দেয়। এই পেশার লোকজনকে বলা হতো ধুনারি। প্রতিবছরই লোকজন গরমের সময় তাদের লেপ-তোশক-বালিশ ইত্যাদি বের করে সেগুলোকে ধুনারির কাছে দিতো। ধুনারিরা লেপ, তোশকের ভেতর থেকে তুলা বের করে নিয়ে ধুনচি দিয়ে ভালো করে ধুনতো। জমাট বেঁধে যাওয়া তুলাগুলো ধুনচির সাহায্যে খোলা হতো এবং নতুন হয়ে ওঠা তুলা দিয়ে তারা আবার লেপ-তোশক ইত্যাদি বানিয়ে দিতো। ধুনারিরা একেক বাড়িতে দুই-তিন দিনও একনাগাড়ে কাজ করতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতো তারা। এরকমই এক ধুনারির গল্প থেকে তৈরি হয়েছে আমাদের আজকের প্রবাদ। 

মালিকেরা সাধারণত একটু চালাক-চতুর কর্মচঞ্চল ধুনারিকেই বেশি পছন্দ করতো। কেননা যে ক'দিন তারা কাজ করবে সে ক'দিন তাদেরকে খাবার দাবার দিতে হয়। যত্ন-আত্তি করতে হয়। বেশি যত্নে বেশি কাজ-এটাই স্বাভাবিক। অলস ধুনারিকে তাই কেউ পছন্দ করে না। একদিন এরকমই এক ধুনারি এক বাড়িতে কাজ করছিল। বাড়ির কর্তা বেশ কটি লেপ-তোশকের তুলা তার সামনে দিলো। ধুনারিও বেশ দ্রুতই কাজে মনোযোগ দিলো এবং ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলো ধুনারি। প্রতিবেশি এক মহিলা দূর থেকে ওই ধুনারির কাজ দেখছিল। মনে মনে বললো: এ তো দেখছি আজব ধুনারি! ভীষণ চটপটে। ওই বাড়ির কাজ শেষ হলে ধুনারিকে নিয়ে আসতে হবে। আমার লেপ, তোশক-বালিশগুলো তাকে দিয়েই ধুনাবো। কী দারুণ কাজই না করছে সে। এতো কর্মচঞ্চল ধুনারি সহজে পাওয়া ভার।


প্রতিবেশি মহিলা যেরকম চিন্তা করলো সেরকমই কাজ করলো। দুই তিনদিন অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ধুনারিকে গিয়ে বললো তার বাসাতেও কিছু কাজ আছে। তুলা ধুনার কাজটা সে করাতে চায়। ধুনারি রাজি হয়ে গেল এবং পরদিনই ওই মহিলার বাড়িতে তুলা ধুনার কাজে লেগে গেল। দুপুর পর্যন্ত মনযোগের সাথে কাজ করলো ধুনারি। বেলা গড়াতেই সে অপেক্ষা করছিল কখোন তার জন্য মজার মজার খাবার নিয়ে হাজির হয় মহিলা। কিন্তু না, কোনো খবর নেই। ক্ষুধা যখন প্রচণ্ড ঠিক সে সময় মহিলা খাবার নিয়ে এলো। খাবার হলো এক বাটি দই-সব্জি স্যুপ আর একটু রুটি। খাবার দেখে ধুনারির পিলে চমকে গেল। গতকালের খাবারের কথা তার মনে পড়ে গেল। 

ধুনারি মনে মনে বললো: সেই সকাল থেকে কাজ করছি, এখন পর্যন্ত এক কাপ চা-ও ভাগ্যে জুটলো না। আর এখন দুপুরের খাবার কিনা দই-সব্জি স্যুপ? আগের বাসায় মজার মজার কাবাব দিয়ে খাবার দিতো। খেয়ে সে নতুন উদ্যম কাজ শুরু করতো। কী আর করা। খেতে তো হবেই। দই-সব্জি স্যুপ খেয়ে নিলো অগত্যা। এখন এই নাশতার মতো খাবার খেয়ে ঝিমুনি আসছে ধুনারির। খেয়ে সে আয়েশ করে তুলা ধুনার কাজে হাত দিলো। সকাল থেকে যেরকম উদ্দীপনার সঙ্গে কাজ করছিলো সেরকম আর কাজ করছে না সে। আগের বাসার কাজের মতো চটপটে কর্মচাঞ্চল্য এখন আর নেই। বিকেল হয়ে এলো। ধুনারি তার মাল-সামানা গুছিয়ে নিলো এবং তার বাড়িতে চলে গেল। পরদিন আবারও সেই মহিলার কাজে লেগে পড়লো।

ধুনারি মনে মনে বললো: গতকাল হয়তো বেচারির ঘরে দই-সব্জি স্যুপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আজ আশা করি দুপুরের খাবারটা ভালোই হবে। এই আশায় সে দুপুর পর্যন্ত ভালোভাবেই কাজ করলো। তারপরও আগের বাসার কাজের গতি মহিলার কাজে ছিল না। যাই হোক, বেলা গড়িয়ে দুপুরের খাবারের সময় হলো। খাবার নিয়ে হাজির হয়ে গেল মহিলা। আজও সেই একই খাবার- দই-সব্জি স্যুপ আর একটু রুটি। পেটে তো কিছু দিতেই হবে-তাই ইচ্ছার বাইরে দই-সব্জি স্যুপ আর রুটি খেয়ে নিলো ধুনারি। খেয়ে-দেয়ে তুলার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। মহিলা অনেকক্ষণ ধরে ধুনুচির শব্দ শুনতে না পেয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলো ধুনারিকে। দেখে তো তার চোখ ছানাবড়া। এ কি! কাজ রেখে ধুনারি তুলার ওপর ঘুমাচ্ছে! 

মহিলা ভাবলো: এই ধুনারি কেন প্রতিবেশির বাড়ির মতো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না! গতকালও সে কেমন যেন অলসতার সাথে ধীরে ধীরে তুলা ধুনছিলো। আমার তো মনে হয় না প্রতিবেশির বাড়িতে সে কাজের ফাঁকে এরকম ঝিমিয়েছে। ভাবাভাবি ছেড়ে মহিলা এক কেটলি চা বানালো। ধুনারির জন্য এক কাপ চা নিয়ে গেল। ধুনারিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মহিলা বললো: তোমার জন্য চা এনেছি। ধুনারি চোখ কচলাতে কচলাতে বললো: অনেক অনেক ধন্যবাদ। মহিলা এবার একটু অভিযোগের সুরেই ধুনারিকে বললো: প্রতিবেশির বাড়িতে তো দেখলাম খুব চঞ্চলতার সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে কাজ করেছো। এখানে কেন এরকম অলস হয়ে পড়লে? যেন কাজ করতেই ইচ্ছে করছে না তোমার? কোনো সমস্যা?


ধুনারি এবার সুযোগ পেয়ে গেল মহিলার অভিযোগের জবাব দেওয়ার। সুন্দর করে বললো: আমি তোমার দই-সব্জি স্যুপের মতোই তুলা ধুনছি। প্রতিবেশির বাড়িতে পোলাও-কাবাব খেয়ে কাজের উদ্দীপনা বেড়ে যেত। তোমার এখানে দই-সব্জি স্যুপ খেয়ে ঘুম পায়। কী করবো আমি। মহিলা ধুনারির কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। কী আর বলবে সে। এই ঘটনার পর থেকে যে কারিগরের কাছ থেকে বেতনের চেয়ে বেশি কাজ আশা করা হয় তখনই বলতে শোনা যায়: তুলা ধুনা হবে দই-স্যুপের মতো।#

পার্সটুডে/এনএম/১/৭৬

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ