পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা-(পর্ব-৯)
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা 'শান্তির গ্যাস পাইপ লাইন' নামে পরিচিত। এই পাইপ লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ২৭৭৫ কিলোমিটার এবং এরমধ্যে প্রায় ১১৫০ কিলোমিটার ইরানে অবস্থিত। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস ভারত উপমহাদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। ওই দেশগুলোর সাথে ইরানের চুক্তি অনুসারে, নয় কোটি ঘনমিটার গ্যাস ভারতকে এবং ছয় কোটি ঘনমিটার গ্যাস পাকিস্তানকে বরাদ্দ করার কথা ছিল। কিন্তু নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এই প্রকল্প আজো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আজকের পর্বে আমরা এ বিষয়ে আ
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার 'শান্তির গ্যাস পাইপলাইন' প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এখন ধারণা করা হচ্ছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তির পর নতুন করে 'শান্তির গ্যাস পাইপলাইন' প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে গ্যাস সরবরাহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লাইন হচ্ছে তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প যা কিনা 'ট্যাপি গ্যাস লাইন' নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে ভারতে কিংবা চীনে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। ইরানের সাথে শত্রুতার কারণে আমেরিকা তুর্কমেনিস্তান থেকে পাকিস্তান ও ভারতে গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। তবে, আমেরিকা এমনভাবে তুর্কমেনিস্তান থেকে গ্যাস আনার বিষয়টিকে সমর্থন দিচ্ছে যাতে সেখানে রাশিয়ার কোনো প্রভাব না থাকে। যদিও ওই প্রকল্প এখন বন্ধ রয়েছে।
তবে, এ অঞ্চলের দেশগুলোর জ্বালানি চাহিদা মেটানোর বিষয়টি কেবল গ্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিদ্যুতেরও বিশাল চাহিদা রয়েছে। 'কাসা ওয়ান থাউজেন্ড' প্রকল্প হচ্ছে কিরগিজিস্তান ও তাজিকিস্তান থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্প। কিরগিজিস্তান এবং তাজিকিস্তানে উচ্চ পানির বাঁধ থাকায় বসন্ত ও গ্রীষ্মঋতুতে পর্যাপ্ত বিদ্যুত উৎপাদন হয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা থাকায় মধ্যএশিয়ার এ দুটি দেশ থেকে বিদ্যুত আমদানি করতে তারা আগ্রহী।
আমেরিকা তার কৌশলগত অবস্থান থেকে 'কাসা ওয়ান থাউজেন্ড' প্রকল্পকে তাদের প্রস্তাবিত 'নিউ সিল্ক রোড প্রকল্প' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, যার মূল উদ্দেশ্য রাশিয়া ও ইরানের ওপর মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর নির্ভরতা কমানো এবং এই দেশগুলোকে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা। তবে, আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই এ অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো সম্ভব।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে এশিয়ার অন্য দেশকেও এর সাথে শামিল করা আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি কৌশলগত লক্ষ্য। এটা যে কেবল মধ্যএশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাবকে খর্ব করবে তাই নয় একই সাথে চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাধা সৃষ্টি করবে বা এর গুরুত্ব কমিয়ে আনবে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বিষয়ক 'কাসা ওয়ান থাউজেন্ড' প্রকল্পের বিষয়ে শুধুমাত্র আমেরিকার নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে তাই নয় সংশ্লিষ্ট আরো অনেক দেশের নিজস্ব লক্ষ্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা মধ্যএশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিযোগিতার দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো 'কাসা ওয়ান থাউজেন্ড' প্রকল্প মধ্যএশিয়ায় পাকিস্তানের প্রভাব বাড়াবে যা ভারতের জন্য মোটেই কাম্য নয়। ভারত কোনোভাবেই পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না। এ অবস্থায় গ্যাস কিংবা বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য ভারতের একমাত্র বিকল্প পথ হচ্ছে ইরান যা কিনা সমুদ্রের মধ্যদিয়ে সরবরাহের সুযোগ রয়েছে।
এদিকে, ইরান ও রাশিয়াকে বাদ দিয়ে আমেরিকা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পক্ষপাতমূলক সহযোগিতা বিস্তারের চেষ্টা করলেও এটা বলা যেতে পারে যে চীন আমেরিকার প্রস্তাবিত "নিউ সিল্ক রোড" প্রকল্পকে আপাতত অচল করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
এ ছাড়া, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প চালু হলে আমেরিকার কথিত "নিউ সিল্ক রোড" প্রকল্প আরো দুর্বল হয়ে পড়বে এবং চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প শক্তিশালী হবে। কিন্তু তারপরও আমেরিকা তার নীতিতে অটল রয়েছে এবং এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে চলে যাওয়াকে ওয়াশিংটন কোনোভাবেই মেনে নিতে চাইছে না। এ কারণে আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় চীনের প্রভাব ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ লক্ষ্যে আমেরিকা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে তাদের সেনা কিছুটা কমিয়ে পূর্বএশিয়ার দিকে সমরশক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে যাতে চীনকে ঘিরে ফেলা যায়।
আমেরিকা, পূর্বএশিয়ায় তার মিত্র দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা জোরদার করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও ভারতের মাধ্যমে বেইজিংকে ঘেরাও করার চেষ্টা করছে এবং ভারত মহাসাগর, মালাক্কা প্রণালী ও দক্ষিণ চীন সাগরে তার প্রভাব জোরদার করার দিকে মনোনিবেশ করেছে। এভাবে আমেরিকা চলতি শতাব্দীতে বিশ্বের ওপর চীনা আধিপত্যকে খর্ব কোরে নিজের ক্ষমতা বা একক আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। বর্তমানে চীনের প্রস্তাবিত সিল্করোড যা 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প নামে পরিচিত এবং আমেরিকার প্রস্তাবিত 'নিউ সিল্করোড' প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দুই পরাশক্তির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক ও আদর্শিক পরাজয় ঘটেছে এবং ওই দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর এখন চীনের সিল্ক রোড প্রকল্পে আফগানিস্তান যোগ দিতে যাচ্ছে। এরফলে ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট তৈরি হতে যাচ্ছে। ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রোড প্রকল্প, পাক-চীনের 'সিপিইসি' ও ইরান-চীনের মধ্যে সহযোগিতার রোড ম্যাপ বাস্তবায়ন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছরের অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির পর আঞ্চলিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে এবং মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞার আর কোনো কার্যকরিতা থাকবে না। চীনসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর স্বার্থে শান্তি পাইপলাইনটি ইরান থেকে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর পর্যন্ত প্রসারিত করা এবং এটিকে গোয়াদর ও চীনের কাশগড় পাইপলাইনের সাথে সংযুক্ত করা প্রয়োজন যা কিনা চীন-পাকিস্তান চুক্তি সিপিইসি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ইরান, চীন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান মনে করে যে এই অঞ্চলে শান্তি পাইপলাইন বাস্তবায়ন কোনো ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতা নয় বরং ঐক্য ও সংহতির পরিবেশ গড়ে তুলবে। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।