গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রবাদ: রুষ্ট কথা, কাটে মাথা
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: 'রুষ্ট কথা, কাটে মাথা'। গল্পটি এরকম:
প্রাচীনকালে এক চোর ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। স্বভাবের কারণে চুরি করতো না, অভাবের কারণে চুরি করতো। চুরি করলেও সে তার বীরত্ব কিংবা সাহস হারায় নি। এক রাতে সে রেশমি কাপড় চুরি করার জন্য একটা কারখানার দেয়াল টপকে ভেতরে গেল। গিয়ে দেখে কারখানার ভেতর বাতি জ্বলছে এবং রেশম শিল্পী মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। মনে মনে বললো: ভাগ্যটাই খারাপ আজ। ফিরে যেতে চাইলো। কিন্তু যাবার আগে খেয়াল করে শুনলো: রেশম তাঁতী কী যেন বিড়বিড় করে বলছে।
কান পেতে শুনলো। রেশম তাঁতী বলছে: হে রুঢ় জিহ্বা! আমাকে রক্ষা করো! কাল যেন জীবন না হারাই। চোরের কৌতূহল হলো। সে ফেরার চিন্তা বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তাঁতী সকাল পর্যন্ত কাপড় বানালো। আবারও সে তার জিহ্বাকে অনুরোধ করলো যেন তার কারণে কোনো নীরস বা অশোভন কথা বলে জীবন না হারাতে হয়। চোর রেশম কাপড়টা ভালো করে দেখলো। সত্যিই চমৎকার। সে মনে মনে চাচ্ছিলো রেশম শিল্পী যেন ঘুমায় যাতে সে কাপড় চুরি করতে পারে এবং বিক্রি করে প্রয়োজন মেটাতে পারে। রেশম কাপড়ের ওপর যেসব ডিজাইন করা হয়েছে দেখা মাত্রই চোখ লেগে যাওয়ার মতো সুন্দর। সুতরাং ভালো দাম পাওয়া যাবে-চোর এরকম ভাবছিল। কিন্তু এখন আর রেশম কাপড়ের প্রতি তার আর তেমন আকর্ষণ নেই। সে এখন কৌতূহলী কাল সকালে কী ঘটে সে বিষয়ে। তাঁতী কখোন, কোথায় যায়, কেন সে এতো ভীত তার কথার জন্য ইত্যাদি বিষয়ে সে জানতে চায়।
সঙ্গে সঙ্গে ঝিমুতে ঝিমুতে ঘুমিয়ে পড়লো এবং কিছুক্ষণ পরই সকাল হয়ে গেল। উঠে গেল সে। বোণা কাপড়গুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে একটা পুটলির ভেতর রেখে রওনা হলো। চোর তার আগেই কারখানা থেকে বেরিয়ে পথে দাঁড়ালো। তাঁত শিল্পীকে যেতে দেখে সালাম দিয়ে জানতে চাইলো: কোথায় যাচ্ছো? তাঁতী বললো: শাসকের দরবারে। এই চমৎকার রেশমি কাপড় বুনেছি তার জন্য। সাধারণ মানুষের কাছে তো এতো বেশি টাকা নেই এরকম দামি রেশমি কাপড় কেনার মতো। চোর বললো: বুঝতে পেরেছি! শাসকের জন্য এই কাপড় নিয়ে যাচ্ছো বেশি টাকা পাবার আশায়। তাঁতী বললো: আল্লাহই ভালো জানে। এমনও তো হতে পারে টাকার পরিবর্তে শাসক জল্লাদের হাতে তুলে দেবে আমাকে!
চোর একবার ভাবছিল তাঁতীকে জিজ্ঞেস করবে সে কেন এরকম চিন্তা করছে! পরে ভাবলো- না, তারচেয়ে ভালো তাঁতীর সঙ্গে প্রাসাদে গিয়ে কাছ থেকে দেখি কী ঘটছে সেখানে। তাঁতীকে কথাটা বলতেই রাজি হয়ে গেল এবং তাঁতী মনে মনে ভাবলো- ও সাথে থাকলে ভয়টা একটু কম লাগতে পারে। ব্যস্ দুজনই এবার পা বাড়ালো শাসকের দরবারের দিকে এবং এক সময় দরবারে পৌঁছে গেল দু'জনই। তাঁতী দরবারে ঢুকেই বাদশাকে কুর্নিশ করলো এবং রেশমি কাপড়গুলো তার সামনে রাখলো। বাদশা কাপড়ের পোটলা খুলে রেশমি কাপড় বের করে দেখলো এবং দরবারে উপস্থিত সবাইকে দেখালো। সবাই ওই চমৎকার কারুকাজ করা রেশমি কাপড় দেখে অবাক হয়ে গেল। সবাই কাপড়ের ডিজাইন নিয়ে কথা বলছিল। বাদশা নিজেও খুশি হলো ওরকম সুন্দর রেশমি কাপড় পেয়ে।
বাদশা সিদ্ধান্ত নিলো চমৎকার এই রেশমি কাপড়ের জন্য তাঁতীকে সে ভালো পুরস্কার দেবে। ওস্তাদ তাঁতীকে ডেকে বললো: তুমি সত্যিই অভিজ্ঞ ও নিপুণ এক রেশম শিল্পী! অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এখন বলো দেখি! এই মূল্যবান রেশমি কাপড় দিয়ে কী হবে? কী কাজে ব্যবহার করলে ভালো হবে? ওস্তাদ তাঁতী কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললো: এতো দামী কাপড় দিয়ে জামা বানানো ঠিক হবে না। আপনি বরং আদেশ দেন এই কাপড় যেন কোষাগারে সংরক্ষণ করা হয়। অসিয়্যত করে যান যে, আপনি মারা গেলে ওই কাপড় যেন আপনার কফিনের ওপর ব্যবহার করা হয়। যে-ই ওই কফিন দেখবে অবাক হবে, অনুতপ্ত হবে। তাঁতীর কথা শুনে বাদশা রেগে গেল এবং বললো: তোর কি আক্কেল-জ্ঞান বলতে কিছু নেই? আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মৃত্যুর কথা বলছিস? আদেশ দিলো: এই রেশমি কাপড় আগুনে পুড়িয়ে দাও! আর ওই তাঁতীর জিহ্বা টেনে বের করে হত্যা করো!
কর্মচারীরা আদেশ পালন করতে উঠে-পড়ে লাগলো এবং দরবারের পরিবেশ হঠাৎ করেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে গেল। এমন সময় চোর সজোরে বললো: জনাব বাদশা! আপনার আদেশ শিরোধার্য! তবে আমি অনুমতি চাচ্ছি তাঁতীর ওরকম কথার রহস্যটা ব্যাখ্যা করতে। তারপর আপনি যা আদেশ দেবেন তাই হবে। বাদশা অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনুমতি দিলো। দরবারের সবাই নীরব। চোর বলতে শুরু করলো: হে বিজ্ঞ বাদশা! আগেকার দিনে বলা হতো: সত্য বললে রক্ষা পাবে। আমি একজন চোর। আমি গতরাতে রেশমি কাপড় চুরি করতে ওই তাঁতীর কারখানায় ঢুকেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম সকাল পর্যন্ত কাপড় বুনতে বুনতে সে বলছিল: হে আমার জিহ্বা, তুমি সংযত হও! আমাকে মরণ থেকে রক্ষা করো! আমি শুনে অবাক হলাম এবং চুরির চিন্তা বাদ দিয়ে এর রহস্যটা উদ্ধার করতে সকাল পর্যন্ত থেকে গেলাম।
চোর বলতে লাগলো: জনাব বাদশা! তাঁত শিল্পী আসলে আপনার অবমাননার জন্য ওকথা বলে নি। তাঁতী আসলে ভয়ে হুশজ্ঞান হারিয়ে কী বলতে কী বলে ফেলেছে, নিজেও জানে না। যার ফলে আপনার রোষানলে পড়েছে। চোরের কথা শুনে বাদশা একটু শতকে গেল। ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলা রেশমি কাপড়গুলো হাতে তুলে নিয়ে চোরকে দিয়ে বললো: এই নে! আর চুরি করবি না, কাজ করবি! এটা তোমার সাহসিকতার পুরস্কার। তারপর রেশম কাপড় বুণন শিল্পীকেও ক্ষমা করে দিলো। তাকে ভালো পুরস্কার দিয়ে বললো: কোনো কথা না বলে সোজা নিজের কাজে চলে যাও!
বাদশাহ তাঁতীকে আরও বললো: ভবিষ্যতে আর কখনও তুমি নিজে আমার জন্য বোণা রেশমি কাপড় নিয়ে আসবে না। অন্য কাউকে পাঠাবে! প্রয়োজনে তোমার এই বন্ধুকে দিয়ে পাঠাবে! আমি নিজেই জানি এই মূল্যবান রেশমি কাপড় দিয়ে কী করবো। বাদশার আদেশ পেয়ে চোর এবং তাঁতী দুজনই রাজ-দরবার থেকে বের হয়ে যে-যার মতো চলে গেল। এই ঘটনার পর থেকে যে-ই কথা বলতে সাবধানতা অবলম্বন না করার কারণে বিপদে পড়ে তার সম্পর্কে বলা হয়: 'রুষ্ট কথা, কাটে মাথা'।
পার্সটুডে/এনএম/৯/৭৮
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ