আগস্ট ১৭, ২০২৩ ১৪:৩৩ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি নি:সঙ্গতা নিয়ে।

নি:সঙ্গতা একটা বয়সে খুবই কষ্টের। তরুণ বয়সেও কষ্টের তবে অনেকে আবার বিষন্নতা কাটাতে একাকীত্ব বেছে নেয়। আসলে সেই নি:সঙ্গতায় বিষন্নতা ঘোচে না বরং আরও জেঁকে বসে। মানুষ হলো সামাজিক জীব। সে একা থাকতে পারে না। কোনো না কোনো ভাবে তাকে অনেকের সঙ্গে চলতেই হয়। মনের আদান প্রদান করতেই হয়। এটা মানবীয় একটা প্রবৃত্তি। 

অনেক নি:সঙ্গ মানুষ তাই বৃদ্ধ বয়সে বিড়াল, খরগোশ কিংবা অন্য কোনো প্রাণী লালন পালন করে। আদর যত্ন করে তাকে পোষে। সময় সুযোগ মতো তার সঙ্গে সে মনের সব কথা শেয়ার করে। সে বুঝলো কি বুঝলো না সেটা বড় কথা নয়। বৃদ্ধ যে তার ভেতরের কথার বুদবুদ বের করে দিতো পারলো সেটাই আনন্দের।

বেশ প্রাচীনকালে এক বৃদ্ধা ছিলেন খুবই দরিদ্র এবং অভাবী। এমনিতেই অভাবী মানুষকে কেউ তো সঙ্গ দিতে চায় না। তদুপরি মহিলা ছিলেন বৃদ্ধা। সুতরাং তিনি একটা বিড়াল পালতেন। ওই বিড়ালটি একদিকে যেমন হালকা-পাতলা, তেমনি খাবার দাবারের অভাবে একেবারে কঙ্কালসার মৃতপ্রায় অবস্থা তার। মজার ব্যাপার হলো বৃদ্ধা মহিলা অভাবী হলেও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন প্রফুল্ল। কোনোরকম দুশ্চিন্তা কিংবা খেতে না পারার কষ্টে কাতর ছিলেন না তিনি। কোনো দু:খ-বেদনাও তাঁকে ক্লিষ্ট করতে পারে নি। সামান্য শুকনো রুটি আর এক কলসি ঠাণ্ডা পানিতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। উল্টো বরং তাঁর যা কিছুই ছিল তার জন্য তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। এভাবেই তিনি খুবই সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। বৃদ্ধা রাত হলে বেড়ালের সঙ্গে গল্প করতেন। তাঁর কাছে যে খাবারই থাকতো বেড়ালের সঙ্গে শেয়ার করে খেতেন। এভাবে বেড়ালের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, আদর-স্নেহ প্রকাশ করতেন।

কিন্তু শীর্ণকায় বেড়াল বুড়ির ওরকম ফকিরি জীবনযাপন পছন্দ করতো না। সে মনে মনে আরও উন্নত জীবন যাপন প্রত্যাশা করতো। এ কারণে সে সারাক্ষণই মিউ মিউ করে কান্নাকাটি করতো। ওরকম কষ্টকর জীবন নিয়ে সে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। তার সমগোত্রিয় যে-কোনো বেড়ালকে দেখলেই সে তার দু:খ-কষ্টের কথা জানাতো এবং ওই অভাবী বুড়ির ব্যাপারে অভিযোগ করতো। এভাবে কেটে যেতে লাগলো দিনের পর দিন। হঠাৎ করে একদিন বুড়ির পাতলা বেড়ালটিকে মোটাতাজা নাদুস-নুদুস একটি বেড়াল দেখতে পেলো। ওই দুই বেড়ালের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। নাদুস-নুদুস বেড়ালটি যখন শুনলো যে তার বন্ধুটি বুড়ির বাসায় বড়ো কষ্টে আছে তখন তার মনে সহানুভূতি জাগলো এবং বললো: হে প্রিয় বন্ধু! তুমি কেন ওই অথর্ব বুড়ির ভাঙাচোরা বাসা ছাড়ছো না? কেন আমার সঙ্গে রাজকীয় অতিথিশালায় আসছো না?


বুড়ির বেড়াল জানতে চাইলো: অতিথিশালা কেমন জায়গা? সেখানে কীরকম খাবার দাবার পাওয়া যায়? মোটা বেড়াল বললো: তোমার যেরকম খাবার খেতে মন চাইবে সেরকম খাবারই সেখানে পাওয়া যায়। গরম মশলাদার খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার-আহা! কী যে মজা! ছাগলের বাচ্চার মাংস থেকে শুরু করে হাঁস, পাখি, রাজহাঁস, হরিণ, খাশি ইত্যাদি সব রকমের মাংস খেতে পাওয়া যাবে। আমাকে দেখছো না? সেখানে কদিন থাকলেই খেয়েদেয়ে আমার মতো নাদুসনুদুস হয়ে যাবে। আমি সর্বোত্তম খাবার খেয়েই মোটা হয়েছি। আমার সঙ্গে এলে এবং আমার কাছে থাকলে তখন বুঝতে পারবে ওই বুড়ির ঘরের শুকনো রুটি আর ক্ষুদ্র ইঁদুর খাওয়ার চেয়েও অনেক ভালো ভালো খাবার আছে। রাজকীয় যেসব খাবার স্বপ্নেও কখনও দেখো নি সেইসব খাবার ওই বাদশাহী অতিথিশালায় খেতে পারবে। বুড়ির বেড়াল রাজি হয়ে গেল এবং বললো: ঠিক আছে! তোমার সাথে যাবো। তুমি যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে ওটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জায়গা আমার জন্য।

বুড়ির বেড়াল শেষ পর্যন্ত মোটা বেড়ালের সঙ্গে পাড়ি জমালো বাদশাহী অতিথিশালায়। সেখানেই যেতেই তার নজরে পড়লো রাজকীয় রান্নাঘর। মজাদার সব খাবারের ঘ্রাণ তার আর সহ্য হলো না। সোজা রান্নাঘরে ঢুকেই বড় বড় পাতিল থেকে মজার মজার সব খাবার খেতে শুরু করে দিলো। বুড়ির বাসায় যেমন সে স্বাধীনভাবে যেখানে খুশি সেখানেই যেতো। সেভাবেই সে এই বাদশাহী অতিথিশালায় স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল। কারণ সে জানতো না যে রাজকীয় অতিথিশালায় বেড়ালদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সুতরাং যা হবার তাই হলো। সুলতানের কর্মচারীরা হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই দিয়েই মারতে শুরু করে দিলো। নিরুপায় হয়ে বেড়াল তার মুখে থাকা মাংসের টুকরোটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দৌড়াতে লাগলো। কিন্তু বাবুর্চিরা ছাড়লো না। তাদের সারাদিনের কষ্টের ফসল নষ্ট করে দেয়ায় বেড়ালের পিছু নিলো এবং দূর থেকে তীর ছুঁড়ে মারলো। সৌভাগ্যক্রমে তীরটা বেড়ালের পায়ে লাগলো।


তীরের আঘাতে বেড়ালের পা থেকে দরদর করে রক্ত বেরুতে লাগলো আর বেড়াল দৌড়তে লাগলো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মিউ মিউ করে চেঁচাতে চেঁচাতে বেচারা বেড়াল এক সময় রাজকীয় বাবুর্চিদের হাত থেকে পালিয়ে রেহাই পেয়ে প্রাণে বাঁচলো। যে বিপদে সে পড়েছিল আর যাই হোক অন্তত প্রাণ নিয়ে তো পালিয়ে বাঁচলো। অবশেষে বেড়াল সেই অভাবী বুড়ির ভাঙাচোরা ঘরেই ফিরে গিয়ে আশ্রয় নিলো। কিন্তু তীরের আঘাতে খুব কষ্ট পাচ্ছিলো বেড়াল। বুড়ির ঘরের এক কোণে বসে মিউ মিউ করে গুঞ্জন তুলে আপন মনে বলতে লাগলো: বন্ধু মোটা বেড়াল তো আমাকে বলেছিলো যে সুলতানের অতিথিশালায় গেলে কয়েক দিনের মধ্যেই খেয়েদেয়ে মোটাসোটা হয়ে যাবো! কিন্তু একথা তো আমাকে বলে নি যে প্রথম দিনেই মার খেয়ে খোঁড়া হয়ে যাবো! 


নাহ! যে পরিমাণ মার খেয়েছি, তাতে মনে হয় না তীর খাওয়ার মতো, খুঁড়িয়ে চলার কষ্টের মতো কিংবা আহত হবার জ্বালার সমান ওইসব খাবারের মূল্য আছে। তারচেয়ে ভালো বুড়ির ঘরের কোণেই পড়ে থাকবো এবং ইঁদুর শিকার করে খাবো আর বুড়ির দেয়া শুকনো রুটি খেয়ে জীবন কাটাবো।

পার্সটুডে/এনএম/১৭/৮২

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ