সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২৩ ১৪:২৭ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি  প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: 

'শব্দ হলো পাঁচ আর রুটি হলো চার? 
আমি তো অবাক হায়, দেখে এ কারবার'। 
গল্পটি এরকম: গরীব এক বৃদ্ধ মহিলা চোখে দেখতো না। দুটি চোখই তার অকেজো ছিল। এদিকে গরীব হবার কারণে তার সেবা করার জন্য যে একজন চাকর বা কানিজ রাখবে তাও পারছিল না। চোখের দৃষ্টি থাকলে তো পরিচিত বন্ধু-বান্ধবকেও বলতে পারতো। কিংবা শরীরেও তো তেমন শক্তি-সামর্থ্য ছিল না যে নিজের এবং বাসার কাজকর্ম করে জীবনটা কোনোরকমে চালিয়ে যেত। 

অনেক কিছুই ছিল না এই বুড়ির। তবে একটা জিনিস ছিল, সেটা হলো-বিবেক-বুদ্ধি। প্রতিবেশিদের কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তারা দৃষ্টিশক্তিহীন এই বুড়ির শরণাপন্ন হতো এবং বুড়ির পরামর্শ চাইতো। বুড়িও বহু চিন্তা-ভাবনা করে তাদের সমস্যার একটা সুষ্ঠু এবং যথোপযুক্ত সমাধান দিয়ে দিত। এভাবেই বুড়ি প্রতিবেশিদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসতো। পক্ষান্তরে প্রতিবেশিরাও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বৃদ্ধার সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করতো। অন্তত চেষ্টা করতো বুড়ির দিনকাল যেন খারাপ না যায়। কেউ তার জন্য গোশত নিয়ে আসতো কেউ আটা, কেউবা আবার ফল। আটা দিয়ে কেউ বানিয়ে দিতে রুটি, কেউ বানাতো খাবার। 

বুড়ির কথা বলছিলাম। একরাতে ওই বৃদ্ধা খাবার দাবার সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। গা-টা বিছানায় এলিয়ে দিতেই হঠাৎ তার কানে চীৎকার চেঁচামেচির শব্দ এলো। শব্দটা বুড়ির প্রতিবেশির বাড়ি থেকে এলো। স্বামি-স্ত্রী ঝগড়া। একজন আরেকজনকে উচ্চস্বরে কথা বলছিল। বৃদ্ধা বিছানা থেকে উঠে পড়লো এবং লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে প্রতিবেশির ঘরের দরোজায় পৌঁছে গেল। দরোজায় টোকা দিতেই দরোজা খুলে গেল এবং বুড়ি ঘরে ঢুকলো। স্বামি এবং স্ত্রী উভয়কে তার দুই পাশে বসালো। দু'জনের কথাই বুড়ি খুব মনোযোগের সঙ্গে শুনলো এবং মিটিয়ে দিলো তাদের সমস্যা। বুড়ি ফিরে গেল নিজের বাসায়। প্রতিবেশি পুরুষ লোকটি বুড়ির এই ভূমিকায় খুব খুশি হলো কিন্তু তার স্ত্রী খুশি হলো না। কারণটা হলো বুড়ি তাকেই দোষী বলে সাব্যস্ত করেছিল। তার স্বামিকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছিল।
পরদিন সকালে বৃদ্ধ মহিলা কিছুটা আটা নিয়ে প্রতিবেশির ঘরের দরোজায় গেল। আটাগুলো প্রতিবেশি মহিলাকে দিয়ে বললো: তুমি তো রুটি বানাচ্ছো-তোমার হাত ব্যথা না করুক! এই আটাগুলো দিয়ে আমার জন্যও কটা রুটি বানিয়ে দাও! প্রতিবেশি মহিলা যেহেতু গতরাতের ঘটনায় বুড়ির ওপর ক্ষেপে ছিল, সোজা বলে দিলো: তোমার আটা দিয়ে খামির করার সময় তো আমার নেই। খামির বানাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। বৃদ্ধ মহিলা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো: অসুবিধা নেই। আমি নিজেই খামির বানাবো। বেচারি তো চোখে দেখতে পেত না তারপরও কষ্ট করে পানি আনলো এবং আন্দাজ করে পানি দিয়ে খামির বানালো। এই ফাঁকে প্রতিবেশি মহিলা তার নিজের ঘরের জন্য তৈরি করা খামির দিয়ে রুটি বানিয়ে শেষ করলো। 

প্রতিবেশি মহিলা নিজের ঘরের রুটিগুলো বানালো। এবার বুড়ি তার নিজের জন্য নিজ হাতে বানানো খামিরগুলো প্রতিবেশি মহিলাকে দিলো রুটি বানিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতিবেশি মহিলা অগত্যা কী আর করবে! নিরুপায় হয়ে ওই খামিরগুলো দিয়ে পাঁচটা গোল্লা বানালো। গোল্লাগুলোকে হাত দিয়ে বেলে পাকানোর জন্য তন্দুরির ভেতরের দেয়ালে সশব্দে সেঁটে দিলো। যারা তন্দুরিতে রুটি বানায় তারা জানে কোনটা কীসের শব্দ। বুড়ি স্পষ্ট শুনতে পেল পাঁচটি রুটি তন্দুরির দেয়ালে সশব্দে সেঁটে দেওয়া হয়েছে পাকানোর জন্য।


তন্দুরিতে পাকানো রুটির আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে। যারা রুটি খেয়ে অভ্যস্থ তাদের কাছে ওই ঘ্রাণ খুবই উপভোগ্য। বুড়ি এবং প্রতিবেশি মহিলা-যে কিনা রুটি পাকিয়ে দিচ্ছে-দু'জনই ঘ্রাণটা উপভোগ করছিল। তন্দুরির রুটি পাকাতে একটু সময় লাগে। দেয়ালের মাটির তাপে রুটি তৈরি হয় তো! সরাসরি আগুনে বানানো হয় না। এজন্য স্বাদটাও অন্যরকম লাগে। যাই হোক দেখতে দেখতে রুটিগুলো তন্দুরির ভেতর থেকে বের করলো প্রতিবেশি মহিলা। কিন্তু ঘটনা একটা ঘটিয়ে বসলো সে। বুড়িকে সে পাঁচটি রুটি না দিয়ে চারটি রুটি দিয়ে একটি সরিয়ে রেখেছিল। বুড়িও তো কম যায় না। সে একটা একটা করে রুটিগুলো গুণে দেখলো। চারটা। আবারও গুনলো-হ্যাঁ চারটাই। এবার প্রতিবেশি মহিলার উদ্দেশে বললো: রুটি চারটা কেন?
                                
রুটি কেন চারটা, কেন পাঁচটা নয়-বুড়ি জানতে চাইলো। প্রতিবেশি মহিলা বললো: তোমার বানানো খামিরে ও কটা রুটিই হয়েছে। বুড়ি বললো: 'তপাশ পাঞ্জ্ ননাশ চহর, মান হেইরনাম আজ ইন কা'র'। মানে হলো তন্দুরের ভেতরের দেয়ালে রুটি সাঁটার শব্দ হলো পাঁচবার অথচ রুটি চারটা? আমি খুবই অবাক হচ্ছি এ ঘটনায়। প্রতিবেশি মহিলা বুঝতে পারলো: এই বুড়ি চোখে না দেখলে কী হবে ভীষণ সতর্ক, তাকে বোকা বানানো সম্ভব না। তড়িঘড়ি করে বললো: দু:খিত, দু:খিত! তোমার একটা রুটি ওদিকে পড়ে গেছে। ভুলে গেছি সেই রুটিটা তুলে এগুলোর ওপর রাখতে। অবশেষে সেই রুটিটাও বুড়িকে দিয়ে দিলো। বুড়ি বুঝতে পেরেছিল তার ওপর প্রতিবেশি মহিলার বিরক্তির কারণ। তাই তাকে বললো: 

আমার ওপর রাগ করা ঠিক হবে না তোমার। সকল ঝগড়ার মূলেই একজনের দোষ থাকে একজন থাকে নির্দোষ। কাজির বিচারে ঝগড়া-ঝাটির দুই পক্ষই কোনোদিন সন্তুষ্ট হয়ে ফিরতে পারে না। প্রতিবেশি মহিলা বুড়ির কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেল। বুড়ির কাছে সে ক্ষমা চাইলো। তারপর বুড়িকে বাসায় ফিরতে সাহায্য করলো। একেবার বুড়ির বাসার দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। এই ঘটনার পর থেকে যখনই কেউ বুঝতে পারে যে কেউ চাচ্ছে তাকে ঠকাতে। তখনই এই প্রবাদটি উচ্চারণ করে: 
'শব্দ হলো পাঁচ আর রুটি হলো চার? 
আমি তো অবাক হায়, দেখে এ কারবার'।

***
পার্সটুডে/এনএম/৯/৯৩
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ
 

ট্যাগ