ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩ ১৭:৫৯ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজকের আসরে আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি গল্প।

গল্পটি এক দরবেশকে নিয়ে যে তার শহর ছেড়ে, ঘর-সংসার ছেড়ে একটা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গিয়ে বাস করতো। গাছের শেকড়, লতাপাতা খেয়ে দিনযাপন করতো। একাকি বসবাস করতো সে। সে কারণে খাবার-দাবার নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তার মাঝে ছিল না। এসব কাহিনী পুরাণের কল্পিত গল্পের মতো শোনালেও শেখার মতো, ভাববার মতো বহু অনুষঙ্গ রয়েছে।

ঘরবাড়ি ছেড়ে এভাবে দরবেশ খোলা প্রান্তরে গিয়ে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল হয়ে পড়লো। প্রাচীন যুগে এরকম প্রবণতা ছিল বলে গল্প-কাহিনীতে পাওয়া যায়। একদিন বাদশাহ তার সাক্ষাতে গেল ওই প্রান্তরে। দরবেশকে বললো: যদি ভালো মনে করো তাহলে শহরে চলে আসো! আমি তোমার জন্য সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়ে দেবো যেখানে বসে তুমি নির্বিঘ্নে এবাদত বন্দেগি করতে পারবে। দরবেশ বাদশাহকে বিনয়ের সঙ্গে বললো সে শহরে যেতে রাজি নয়। প্রান্তরে বসবাস করাকে সে অপছন্দ করছে না। যেদিন থেকে শহর ছেড়ে এই মরুপ্রান্তরে এসে বসবাস করছে সেদিন থেকে নাকি সে আল্লাহকে আরও ভালো করে এবং বেশি করে চিনতে পারছে। বাদশাহ অবাক হলো আর দরবেশ আরও বলতে লাগলো। কী বললো তা শুনবো খানিক মিউজিক বিরতির পর।

দরবেশ আরও বললো: এখানকার প্রতিটি গাছই সৃষ্টি সম্পর্কে পাঠ্য একেকটি খোলা বই। গাছের প্রতিটি পাতাই সেই বইয়ের একেকটি পৃষ্ঠা যা পড়ে আপনি বহু বিষয় শিখতে পারেন। শোনেন নি কোনো একজন কবি বলেছেন:

গাছের প্রতিটি সবুজ পাতা 
জ্ঞানীদের চোখে অর্থময়
খোলা কোনো নোটবুক যেন তা 
মুদ্রিত স্রষ্টার পরিচয়

বাদশাহ বললো: যদি শহরে আসো আমি তোমার জন্য একটা প্রাসাদ ছেড়ে দেবো। সেখানে তুমি থাকবে এবং খোদার ইবাদাত বন্দেগি করবে। তুমি এলে তোমাকে দেখে, তোমার কাজ-কারবার, ইবাদাত, আচার-আচরণ এককথায় তোমার অস্তিত্বের বরকতে অন্যরাও তাকওয়াবান হয়ে উঠবে। তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে।

বাদশাহ আরও বললেন: সেখানে তুমি আমার এবং আমার চারপাশের সবার জন্য উত্তম আদর্শে পরিণত হতে পারবে। এভাবে আমাদেরকে তুমি সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে। বাদশাহর কথা শুনে দরবেশ একটু গম্ভীর হয়ে গেল। আবারও কেমন যেন আমতা আমতা করলো এবং শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবে রাজি হতে পারলো না। বাদশাহর সঙ্গে তাঁর একজন মন্ত্রী ছিল। সেই মন্ত্রী বললো: হে দরবেশ! বাদশাহর প্রস্তাব গ্রহণ না করাটা কি ঠিক হচ্ছে! ভালো হতো না যদি বাদশাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিছুদিনের জন্য হলেও শহরে এসে প্রাসাদে বসবাস করতে! মন্ত্রী আরও অনেক কথা বলেছে দরবেশকে।

মন্ত্রী দরবেশকে আরও বললো: তুমি যদি প্রাসাদে যাও তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। কিছুদিন সেখানে থাকলে, আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগি করলে! তারপর যদি তোমার ভালো না লাগে চলে তো আসতে পারবে আবার এখানে। এই মরুপ্রান্তর তো আর তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তোমার জন্য থেকে যাবে। তোমাকে আমরা জোর করে শহরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতে চাচ্ছি না। দরবেশ মনে মনে একটু ভাবলো: প্রস্তাবটা তো মন্দ না, পরীক্ষা করতে দোষ কী! মন্ত্রী যেভাবে বলছে তাতে তো কোনো ক্ষতি দেখছি না। দরবেশ মন্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল এবং বললো: পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকদিনের জন্য শহরে গিয়ে প্রাসাদে থাকবে। তাই হলো। বাদশাহ তাঁর চাকরদের বলে দিলো দরবেশের সেবা করতে যাতে দরবেশ ভালোভাবে ইবাদাতে মশগুল হতে পারে। সেবকরা দরবেশকে খেতে ডাকলো। দরবেশ এলো খেতে। রাজকীয় খাবার দাবার খেয়ে বাগানে পায়চারী করতে ভালোই লাগছিল দরবেশের।

এভাবে আরাম আয়েশে কাটতে লাগলো তার দিনকাল। ধীরে ধীরে ইবাদাত ভুলে যেতে লাগলো দরবেশ। প্রাসাদে আসার কারণও ভুলে গেল। কিছুদিন পর বাদশাহ দরবেশের ঘরে গেল। দেখলো দরবেশের আগের রূপ আর নেই। মোটা নাদুস নুদুস হয়ে গেছে শরীর। দরবেশের সঙ্গে কথা বলে ফেরার সময় বাদশাহ বললো: পৃথিবীতে আমি দুটি শ্রেণীকে পছন্দ করি। জ্ঞানী-গুণী এবং আবেদ-দরবেশ। তাদের জন্য আমি আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করতে ভালোবাসি। বাদশাহর সঙ্গে তার দার্শনিক মন্ত্রীও ছিল। সে বললো: ভালোবাসার একটা শর্ত আছে। তা হলো: উভয় শ্রেণীকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা।  বাদশাহ শুনে বললো: কী বলতে চাও?

বাদশাহ মন্ত্রীর কথায় জানতে চাইলেন: কী বলতে চাও, আমি কি তাদের সঙ্গে সদাচরণ করি নি, তাদের কল্যাণে কাজ করি নি? আর কেউ না জানুক তুমিতো জানো তাদের আরাম আয়েশের জন্য আমি কী না করেছি! মন্ত্রী বললো: কিন্তু এই দুই দলের প্রত্যেকের মঙ্গল আর কল্যাণ অন্যদের থেকে আলাদা। আপনি যদি তাদের সাথে ভাল এবং ন্যায়বিচার করতে চান তবে আমার পরামর্শ শুনে তা বাস্তবায়ন করলে ভালো হবে। মন্ত্রীর ঔদ্ধত্য দেখে বাদশাহ ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়ে গেল। মনে মনে বললো: এই মন্ত্রী তো অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী। এরকম কথার পেছনে তার অবশ্যই কোনো উদ্দেশ্য আছে। নিরর্থক কথা বলার লোক তো সে নয়। তাকে কখনো এরকম ঔদ্ধত্য দেখাতে দেখি নি। বাদশাহ মন্ত্রীকে বললো: ঠিক আছে বলো, কী পরামর্শ তোমার।

মন্ত্রী এবার দরবেশের পেটের দিকে ইশারা করে বললেন: এখানে আসার আগে এই ভুঁড়ি ছিল না। এই বলে অর্থবহ হাসি দিলেন। বাদশাহ ওই হাসির অর্থ খুব সহজেই বুঝে ফেললো এবং নিজেও হাসলো। মন্ত্রী এবার বললো: জ্ঞানী-গুণী মণীষীদেরকে পুরস্কার দাও যাতে তারা আরও গবেষণা করে। দরবেশদেরকে কি কিছু দেওয়া উচিত না যাতে তারা দরবেশ থেকে যায়? বাদশাহ হেসে দিলো। কিছুই বললো না। তবে মনে মনে চিন্তা করলো: অভিজ্ঞ মন্ত্রী তার যথার্থ বলেছে। আমিই ভুল করেছি। এই দরবেশ তো এখন আর দরবেশও না জ্ঞানীও না। সে তো এখন পেটপূজারি হয়ে গেছে। তা না হলে এ কয়দিনে সে এমন শ্বেত-লাল ভুঁড়িওয়ালা হয়ে যেত না।#

পার্সটুডে/এনএম/২৬/১২০

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

 

ট্যাগ