সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩ ১৪:৫১ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: 'ভাল্লুকের কামারগিরি' মানে ভাল্লুককে কামারের কাজ করতে বাধ্য করানো। বেশ মজার না ব্যাপারটা। চলুন এর পেছনের গল্পটি এবার শুনি।

বেশ প্রাচীনকালে এক কামার ছিল। ওই কামার তার কারখানায় একাই সব কাজ করতো। তার কাজ কিন্তু অনেক ছিল। কিন্তু কাজ করার মতো কোনো লোক তার সঙ্গে কাজ করতে রাজি ছিল না। কেউই তার শাগরেদ হতে চাইতো না। তাকে সহযোগিতা করতে চাইতো না।

কামারের কাজ তো! লোহা-লক্কড় পুড়িয়ে গলিয়ে তা দিয়ে নতুন নতুন হাতিয়ার বানাতে হতো। এইসব কাজ খুব একটা সহজ ছিল না। খুবই কঠিন কাজ এগুলো। বিশেষ করে যদি আবহাওয়া গরম থাকতো তাহলে তো আর কথাই নেই। হাপরের বাতাসে কামারশালা কীরকম গরম হয়ে উঠতো তা ভাবলেই আর কারও ওই কাজের প্রতি আগ্রহ জাগতো না। সুতরাং কামারের পেশা যার তার নয়। সেজন্য কামার তার শাগরেদদেরকে অন্য জায়গার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মজুরি দিতেও প্রস্তুত ছিল। তারপরও কেউ কামারের সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করতে রাজি হয় নি। একদিনের ঘটনা বলি।

একদিন কামার তার পেশাগত কাজেই শহরের বাইরে গেল। যাবার পথে দেখলো-একটা ভাল্লুক একটা গাছের নীচে ঘুমিয়ে আছে। ভাল্লুককে দেখেই কামারের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। মনে মনে সে বললো: কেউই যেহেতু আমার শাগরেদ হতে চায় না, তাই এই বিশালদেহি ভাল্লুকটাকে যদি আমার সঙ্গে শহরে নিয়ে যাই এবং আমার সঙ্গে কামারশালায় কাজ করতে তাকে বাধ্য করি, তাহলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে মনে মনে খুশিই হলো কামার। সে একটা দড়ি দিয়ে ভাল্লুকের গলায় গিঁট দিলো এবং তাকে তুলে নিয়ে হাতে রশি ধরে টেনে টেনে শহরের দিকে রওনা হলো। শহরে পৌঁছে ক্ষুধার্ত ভাল্লুককে আগে খাবার দিলো এবং সোজা নিয়ে গেল কামারশালায়।

তারপরের দিন থেকেই কামার ভাল্লুকের চোখের সামনে কামারের কাজ করতে লাগলো। কামার চেষ্টা করছিল হাতুড়ি চালানো এবং লোহা পেটানোর কৌশল ভাল্লুককে শেখাতে। যতবেশি সে চেষ্টা করলো তত কম ফল পেলো। কামার আস্তে আস্তে ভাল্লুককে তার মতো কামার বানানোর আশা ছেড়ে দিলো। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো লোকজন বিশেষ করে প্রতিবেশিরা বুঝলো কামার একটা ভাল্লুককে তার কাজ শেখানোর চেষ্টা করছে। সুতরাং তারা ঠাট্ট-মশকরা করতে শুরু করে দিলো এবং এভাবে তারা কামারকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে আরও বেশি মনোপীড়া দিতে লাগলো।

পাড়া-প্রতিবেশিরা ভাল্লুককে কামার কাজ শেখানোর চেষ্টায় হাসাহাসি করতে লাগলো, তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগলো। এমনকি তার বন্ধু-বান্ধরাও। তারা বলতে লাগলো: ভাল্লুক মামার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাচ্ছো-এসব ছাড়ো! কামার বেচারা চারদিক থেকে লোকদের ঠাট্টা আর ভাল্লুকের আচরণে বিরক্ত হয়ে কাজকর্ম, ঘরবাড়ি, শহরের মানুষ এবং ভাল্লুককে ছেড়ে হতাশ হয়ে পাহাড় কিংবা মরুভূমিতে চলে যাবার কথা ভাবছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো যে তার কাজকর্মের অবস্থাই পাল্টে গেল। কামার পরদিন থেকেই মোরগ এবং মেষকেও তার কামারশালায় নিয়ে গেল এবং ভাল্লুকের পাশে নিয়ে রাখলো। প্রথমদিন সে মোরগকে খাবার দিলো এবং শব্দ করে বললো ভালো করে খাও! কাল কিন্তু কামারগিরি করতে হবে।

মোরগ তার জন্য ছিটানো শস্যদানাগুলো সব খেলো। পরদিনও তাকে কিছু শস্যদানা খেতে দিলো। তারপর কামার মোরগকে বললো: এই হাতুড়িটা নাও, কামারগিরি করো। মোরগ মাটি থেকে এক এক করে শস্যদানা তুলে নিয়ে চলে গেল। কামার মোরগের উদাসীনতায় রেগে গেল। মোরগটাকে ধরলো কামার। মেষ আর ভাল্লুকের চোখের সামনে তাকে জবাই করে ফেললো। চামড়া ছুলে নিয়ে চুল্লিতে দিয়ে কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেললো। এরপর বললো: যে আমার কথা শুনবে না তারও এই অবস্থা হবে। পরদিন কামার মেষকে বেশি করে ঘাস খেতে দিলো। তারপর হাতুড়ি দিয়ে বললো: আজ তোর পালা। আমাকে সাহায্য কর! মেষ তো আর মানুষের কথা বুঝতে পারে না। সে তার মতো ব্যাঁ ব্যাঁ করতে করতে ঘাসগুলো খেলো, পানিও খেলো।

 কামার এই অবহেলার কারণে রেগে গিয়ে মেষটাকেও জবাই করে চামড়া ছুলে চুল্লিতে কাবাব বানিয়ে খেলো। পরের দিন কামার ভাল্লুককে সামান্য খাবার খেতে দিয়ে বললো: খাবার খেয়ে হাতুড়িটা নিয়ে আমাকে একটু সাহায্য করো! ভাল্লুক দ্রুত খাবার খেয়ে নিয়ে হাতুড়িটা ধরলো এবং কিছু বলার আগেই সে কামারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কামার সে সময় পোড়ানো লোহা চুল্লি থেকে বের করে করে লোহার ওপর রেখে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছিলো। ভাল্লুক এরকম হাতুড়ি পেটা খেয়ে প্রাণ হারানোর ভয়ে পোড়া লোহাকে পিটিয়ে অবিশ্বাস্যরকমভাবে কামারগিরি করলো।

এই ঘটনা শুনে সবাই তো অবাক। ওইদিনের পর থেকে ভাল্লুকের কাছ থেকে কামারগিরিতে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য যারা মশকরা করতো তারা কামারশালায় যাওয়া-আসা বাড়িয়ে দিলো। বিস্ময়ের সাথে ভাল্লুকের কামারগিরি দেখতে লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যে এই কাহিনী সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। এই ঘটনার পর যখনই কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনো অক্ষম কিংবা বোকার ওপর সোপর্দ করতো তখনই বলতো: এটা তো 'ভাল্লুকের কামারগিরি'।
পার্সটুডে/এনএম/২১/৯৯
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ
 

ট্যাগ