সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩ ১৭:৪৪ Asia/Dhaka
  • ইরানি প্রবাদ: সবার সঙ্গে জি জি, আমার সঙ্গেও?

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: "সবার সঙ্গে জি জি, আমার সঙ্গেও?" এই প্রবাদের পেছনে মজার একটি গল্প আছে। গল্পটি এরকম:

প্রাচীনকালে এক শহরে বাস করতো এক ব্যবসায়ী। বহু বছর ধরে ব্যবসা বাণিজ্য করার পর একটা সময় বেচারা বেশ সমস্যায় পড়ে গেল। সে যাই কিনতো সেটারই দাম পড়ে যেত। আবার কোনো কিছু বিক্রি করার পর হুট করে তার দাম ব্যাপক বেড়ে যেত।

ভাগ্যের এরকম নির্মম বিড়ম্বনায় ব্যবসায়ীর অর্জিত ধন-সম্পদ যা ছিল ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। ভাগ্য একদিন হয়তো ফিরে আসবে-এই আশায় আশায় ব্যবসায়ী তার দোকান অঅর বন্ধ করলো না। তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছ থেকে বিভিন্ন মালামাল বাকিতে কিনে এনে দোকানে তুললো। এভাবে সে প্রায় সবার কাছেই ঋণী হয়ে গেলেও দোকান কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ রয়ে গেল। আবারও ক্রেতা সাধারণ তার দোকানে এলো এবং কেনাকাটা করলো। কিন্তু দিনশেষে সে হিসেব করে দেখলো আগের মতোই সে ক্ষতিগ্রস্তই হলো, লাভবান হতে পারলো না। এভাবে একের পর এক ক্ষতির পর ক্ষতি হতে হতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছলো যে ব্যবসায়ী আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারলো না। 

লোকসানের পর লোকসান। সবার কাছে ঋণী এমনকি শহরের বাজারেও অনেক ব্যবসায়ীর কাছে ঋণে জর্জরিত হয়ে গেল ব্যবসায়ী। যারা টাকা পেত তার কাছে আসতে লাগলো ঋণের টাকা চাইতে। যতই আসতো ততই সে তার দুর্দশার কথা বলতো। কিছুই দিতে পারতো না। অবশেষে পাওনাদাররা শহরের কাজির কাছে গিয়ে বিচার দিলো। ব্যবসায়ীর কানে কথাটা যেতেই সে বুঝতে পারলো যে অনতিবিলম্বে তাকে আদালতে ডাকা হবে এবং ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কারাগারে যেতে হবে। এই অবস্থা মুক্তি পেতে বেচারা সবার দ্বারস্থ হলো। কোনো কাজ হলো না। অবশেষে গেল তার এক পাওনাদারের কাছে। এই পাওনাদার তার কাছে অন্যদের তুলনায় কম এসেছে ঋণের টাকার জন্য।

তার কাছে ব্যবসায়ী নিজের সকল সমস্যার কথা চুলচেরা তুলে ধরে বললো: এখন কী করবো, বুঝতে পারছি না। পাওনাদার একটু ভেবেচিন্তে বললো: তোমাকে এমন একটা উপায় দেখাবে যা দেখে কাজির মন গলে যাবে এবং তোমাকে আর জেলেও পাঠাবে না। তবে এই বুদ্ধি দেওয়ার জন্য একটা শর্ত আছে। ব্যবসায়ী এই জঞ্জাল থেকে বাঁচার স্বার্থে যে-কোনো শর্তই মানতে রাজি হলো। পাওনাদার বললো: তুই তো নিজের মুক্তি নিয়েই ব্যস্ত। আমি ভাবছি কী করে তোর কাছ থেকে পাওনা টাকা বুঝে নিতে পারি। অন্যদের কথা আমি ভাবছি না। আমার শর্ত হলো: অন্যদের দেনা পরিশোধ করা থেকে মুক্তি পাবার পর আমি যত টাকা চাইবো তত টাকা দিবি। এক টাকাও কমবেশি করা চলবে না। ব্যবসায়ী রাজি হয়ে গেল। 
পাওনাদার এবার ব্যবসায়ীকে বুদ্ধি দিলো। বললো: তুই যখন কাজির সামনে যাবি তোকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে। তুই শুধু বলবি-জি, জি! পাওনাদাররা যদি তোকে খারাপ কথাও বলে তুই জি জি বলবি। ব্যবসায়ী মেনে নিলো। বুদ্ধিদাতা পাওনাদার আবারও তার শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলো। ব্যবসায়ী মেনে নিলো। কয়েকদিন পর আদালতে হাজির হবার জন্য ডাক পড়লো ব্যবসায়ীর। পাওনাদাররা সবাই কাজির সামনে হাজির হলো। তারা একে অপরের সঙ্গে এটাসেটা বলাবলি করছিল। কাজি ব্যবসায়ীকে বললো: এরা সবাই তোমার কাছে টাকা পাবে-কথাটা কি সথ্য?
ব্যবসায়ী: জি জি!
কাজি: তুমি ওদের পাওনা পরিশোধ করছো না কেন?
ব্যবসায়ী: জি জি!
কাজি: এদের কাছ থেকে যে টাকা এবং জিনিস নিয়েছো, কী করেছো?
ব্যবসায়ী: জি জি!
কাজী বিরক্ত হয়ে বললো: আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছো না কেন? ব্যবসায়ী বললো: 'জি জি'! সেদিন যে যাই জিজ্ঞেস করেছিল তাকে সে জি জি ছাড়া আর কোনো উত্তর দেয় নি। একজন বললো: আমাদের টাকা দিবি কি দিবি না? ব্যবসায়ী বললো: জি জি!
আরেকজন বললো: তুই সব টাকা মেরে দিতে চাস নাকি?
ব্যবসায়ী: জি জি!
পুরো ঘটনাই কাজির সামনে ঘটলো। কাজি সবাইকে চুপ করতে বললো। বেচারা ব্যবসায়ীর জন্য তার মন পুড়লো। পাওনাদারদের উদ্দেশে বললো: এই বেচারা পাগল হয়ে গেছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ আর পাওনাদারদের কাছ থেকে আত্মগোপন করে থাকতে থাকতে সে পাগল হয়ে গেছে। পাগলকে তো শাস্তি দেওয়া যায় না, কারাগারেও দেওয়া যাবে না। তোমরা বরং ওকে ছেড়ে দাও, নিজেদের কাজেকর্মে চলে যাও!
বেচারা পাওনাদাররা নিরুপায় হয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং কাজির দরবার থেকে চলে গেল। দেউলিয়া ব্যবসায়ীও জি জি বলতে বলতে আদালত ত্যাগ করলো। সে ভীষণ খুশি হলো কেননা এরচেয়ে ভালো আর কী আশা করা যেত? এই ঘটনার কয়েকদিন পর যে পাওনাদার ব্যবসায়ী এই বুদ্ধি দিয়েছিল সে ব্যবসায়ীর বাসায় গিয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো: ভালো আছো?
ভ্যবসায়ী: জি জি! 
পাওনাদার বললো: দেখলে তো আমার বুদ্ধিতে কীভাবে তুমি মুক্তি পেলে?
ব্যবসায়ী: জি জি!
পাওনাদার: এখন তাহলে মুক্তি তো পেলে! আমার পাওনা টাকাগুলো এবার দিয়ে দাও! যেমনটি কথা ছিল।
ব্যবসায়ী বললো: জি জি!
পাওনাদার: কখোন দেবে টাকা।
ব্যবসায়ী বললো: জি জি!
পাওনাদার বললো: দ্যাখো! কথা ছিল তুমি নিজে টাকা দিয়ে যাবে আমাকে।
ব্যবসায়ী বললো: 'জি জি'! পাওনাদার বললো: 'দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও! আমার পাওনা টাকা নিয়ে আসো'! ব্যবসায়ী বললো: জি জি!
পাওনাদার বললো: 'পাগল হয়ে গেছো নাকি! জি জি বললে তো কাজ হবে না। টাকা নিয়ে আসো'! ব্যবসায় তবুও বললো: জি জি! 
যতো কথাই বলা হলো 'জি জি' ছাড়া আর কিছুই বললো না ব্যবসায়ী। পাওনাদার বুঝে ফেললো ব্যবসায়ী কথা রাখতে চাচ্ছে না এবং তার পাওনা টাকাও ফেরত দিতে চাচ্ছে না। নিরাশ হয়ে ব্যবসায়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো:'সবার সঙ্গে জি জি, আমার সঙ্গেও'! ব্যবসায়ী এবারও বললো: জি জি! এই ঘটনার পর কেউ যদি উপকারীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে কিংবা তাকে সম্মান না করে অথবা প্রাপ্য বুঝিয়ে না দেয়, তার সম্পর্কে বলা হয়: সবার সঙ্গে জি জি, আমার সঙ্গেও?

পার্সটুডে/এনএম/২৫/১০১

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ