অক্টোবর ০৯, ২০২৩ ১৭:৫৬ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি  গল্প। গল্পটি এরকম:

মৌসুমি ঋতুর সংখ্যা একেক দেশে একেক রকম। বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। কিন্তু ইরান চার ঋতুর। ইরানে বর্ষা ঋতু আর হেমন্ত ঋতু নেই। যাই হোক, পৃথিবীজুড়ে বসন্তই হলো ঋতুর রাজা-ঋতুরাজ। বসন্তে কেবল যে আবহাওয়াই চমৎকার থাকে তাই নয়। বরং আবহাওয়ার পাশাপাশি পুরো প্রকৃতিতেই প্রাণের জোয়ার আসে। সাধারণত ঠাণ্ডার পরই আসে বসন্ত। ঠাণ্ডার আগে থেকেই মানে শরতের সূচনাতেই গাছের পাতারা ঝরে যেতে শুরু করে। ঠাণ্ডার সময় তো গাছগুলো হরিণের শিংয়ের মতো পত্র-পল্লবহীন হয়ে পড়ে।
আবার বসন্তের সূচনায় প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। গাছে গাছে পাতা গজায়। পাতার পরে ফোটে বিচিত্র ফুল। চারদিক ফুলে ফুলে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এরকমই এক বসন্তে সবকিছু ছিল সুন্দর পরিপাটি। বনের গাছগাছালি আর পাতা-ফুল ও ফল সূর্যের নিচে জ্বলজ্বল করছিল। নবীন সবুজ পাতায় সূর্যের আলোর প্রতিচ্ছবি অন্যরকম সৌন্দর্য ছড়ায়। দৃষ্টিবানদের চোখই কেবল ওই সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যায়। বাগানেই ছিল পিঁপড়া আর ঘাসফড়িং। তারা ছিল পরস্পরে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে অপরের কাছাকাছি থাকতো তারা সবসময়।

পিঁপড়ার কথা তো আপনারা জানেন।  তারা ভীষণ সচেতন। ভবিষ্যত নিয়ে তারা খুব সতর্ক থাকে সবসময়। শীতের ডামাডোলে যখন বাইরে বের হবার সুযোগ থাকে না কিংবা সুযোগ থাকলেও খাবারের সন্ধান মেলে না তখন কী খাবে তারা, কোত্থেকে খাবার জোগাড় করবে! এই চিন্তা থেকে তারা গরমের সময়ই খাবার মজুদ করতে থাকে। তাই এই বসন্তেই পিঁপড়া ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। পিঁপড়া আশ্চর্যরকম ক্ষমতা হলো তারা তাদের শরীরের চেয়ে বেশি ওজনের জিনিস বহন করে নিয়ে যেতে পারে। তা্ করছিল পিঁপড়া। ভারী শস্য পণ্যগুলো সে বহন করে করে সরিয়ে নিয়ে গুদামে রাখছিল। শীত মৌসুমের খাবারের আয়োজন করছিল সে। কিন্তু ঘাসফড়িং ব্যাপক হাসিখুশিতে বিভোর ছিল। সূর্যালোকের নীচে, সুন্দর ফুল আর সবুজ ঘাসের মাঝখানে বসে আবার কখনো গাছের ডালে হেলান দিয়ে বসন্তের গান গাইতে লাগলো। সে মনে মনে বলল: এরকম হাসিখুশি জীবনই আমার পছন্দ। আমি সবসময় গান করতে এবং খেলাধুলা করতে ভালোবাসি। এই মনোরম বাসন্তি আবহাওয়ায় কার ইচ্ছে করে কাজ করতে?
পিঁপড়ে প্রতিদিনই অল্প অল্প করে খাবার সংগ্রহ করছিল। সেগুলোকে সে গাছের গুঁড়ির গর্তে মওজুদ করছিল। ফল-পাকগা, শস্যদানা যাই পেত সংগ্রহ করতো সে। এমনকি শীতের বরফ ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আগুন জ্বালানোর জন্য লাকড়িও সংগ্রহ করছিল। অপরদিকে অলস ঘাসফড়িং সূর্যের নরম আলোয় ঘুমিয়ে আরাম-আয়েশ করে সময় কাটাচ্ছিল। সেই দক্ষিণা শীতল সমীরে গা এলিয়ে দিয়ে মনের সুখে গান গেয়ে গেয়ে সময় পার করছিল। ফসল তোলার মৌসুমে পিঁপড়া গভীর মনোযোগের সঙ্গে অবিরাম কাজ করছিল। সে নিজেই ঘাসের ডালপালা দিয়ে মই তৈরি করলো। ওই মই দিয়ে সে গমের ডালপালা বেয়ে উপরে উঠে রুটি তৈরির জন্য গমের দানা সংগ্রহ করতে লাগলো। অলস ফড়িং পিঁপড়ার কাছে বসে বসে মনের সুখে নতুন নতুন গান গাইতে লাগলো। পিঁপড়াকে সে বললো: আমার মত কে এমন সুন্দর করে গান গাইতে পারে? আমার কন্ঠ অনেক সুন্দর।

বসন্ত পেরিয়ে শরতের ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টির মওসুম। পিঁপড়ে তারপরও আগের মতোই তার কাজ করে যাচ্ছিলো। গাছের পাতারা ঝরতে শুরু করলো। অলস ফড়িং বিমর্ষ ও মনমরা হয়ে গাছের পাতার নীচে দাঁড়িয়ে রইলো নিজেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য। আস্তে আস্তে শীত এসে গেল এবং বরফ পড়তে শুরু করলো। ফড়িংয়ের খাবার দাবার বলতে কিছু অবশিষ্ট রইলো না। ওই শীতার্ত হাওয়ায় বেচারা ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়লো। এতোই কাতর যে তার মুখ দিয়ে গান বের হচ্ছিলো না। অন্যদিকে পিঁপড়া, সে তার উষ্ণ ঘরে ছোট্ট একটা চেয়ারের ওপর বসে আরাম করছিল। ফড়িং মনে মনে বললো: পিঁপড়ার ঘরে যাবো এবং তার কাছে সাহায্য চাইবো।

ফড়িং আরও বললো: আমি জানি তার কাছে খাবার আছে এবং তার ঘর বেশ উষ্ণ ও আরামের। ফড়িং দরোজায় কড়া নাড়লো। পিঁপড়ে দরোজা খুলে দিতেই সামনে ফড়িংকে দেখতে পেলো। পিঁপড়ে জিজ্ঞেস করলো: কী ব্যাপার? কী চাও তুমি? ফড়িং জবাবে বললো: প্রিয় বন্ধু আমার! আমি খুবই ক্ষুধার্ত! সেইসঙ্গে ভীষণ ঠাণ্ডায় জবুথবু অবস্থা। আমাকে দয়া করে একটু খাবার দাও আর একটু লাকড়ি দাও আগুন জ্বালাবো। পিঁপড়ে বললো: এই যে লম্বা সময় ধরে গরম ঋতু গেল, কী করেছো তখন? অলস সময় কাটিয়েছো। গান-বাজনা করে ফূর্তি করে যা খুশি তাই করেছো। আর আমাকে কাজ করতে দেখে ঠাট্টা-মশকরা করেছো। মনে পড়ে তোমার?

পিঁপড়ে তার বন্ধু ফড়িংকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো বিগত সময়ের কথা। বলছিলো যে আমি যখন কাজ করছিলাম তুমি তখন আমাকে ঠাট্টা মশকরা করছিলে। তোমাকে আমি উপদেশও দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমার কোনো কথাই কানে তোলো নি। বলেছিলাম না-এতো আরাম-আয়েশ না করে শীতের জন্য সঞ্চয় করো! দু:সময়ের জণ্য নিজেকে প্রস্তুত করো! পুরো গরম ঋতুটাকে তুমি গান গেয়ে, ফূর্তি করে কাটিয়েছো! এখন যাও সেভাবেই নাচো, গাও, যেমন খুশি তেমন করে জীবন যাপন করো! ফড়িং বন্ধু পিঁপড়ের কথা শুনে মাথা নীচু করে রইলো। ওই অবস্থার মধ্যেই পিঁপড়ে তার ঘরের দরোজা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো।

হঠাৎ করে পিঁপড়ের বাসার সামনে নেমে এলো সুনসান নীরবতা। একটা গুমোট অবস্থা তৈরি হলো। বন্ধুর জন্য পিঁপড়ের মন কিন্তু ঠিকই পোড়ে। তবে যেরকমভাবে অলস সময় কাটিয়েছে সে, নাচ- গানের মতো বিনোদনমূলক কাজ করে কাটিয়েছে পুরোটা বসন্ত সে কারণে তার ওপর পিঁপড়ের রাগ হয়েছে। এভাবে কিছুটা সময় কেটে গেল। পিঁপড়ে আবারও তার বাসার দরোজা খুললো। দেখলো ফড়িং সেভাবেই অসহায় চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘরের ভেতর ডেকে নিলো। খাবার দাবার খেতে দিলো এবং উষ্ণতার ব্যবস্থা করে দিয়ে তাকে থাকতে দিলো।
পার্সটুডে/এনএম/৯/১১০

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ