অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-৬)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা আব্বাসিয় খেলাফতের সময় অন্যান্য জাতির গ্রন্থ ও জ্ঞানগবেষণা আরবি ভাষায় অনুবাদের কথা উল্লেখ করেছিলাম।
প্রকৃতপক্ষে, এই সময়কালকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। প্রথম সময়কালটি হচ্ছে, ১৩৬ থেকে ১৯৩ হিজরি পর্যন্ত অর্থাৎ মানসুরের খেলাফতের সময় থেকে হারুন আল-রশিদের খেলাফতের শেষ পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় সময়কালটি হচ্ছে, মামুন আব্বাসির খিলাফতের সময় যা ছিল হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শেষ অর্থাৎ ইংরেজি এগারো শতকের প্রথম দিকে। দ্বিতীয় সময়কাল প্রথম সময়কালের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়কালে বহু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের চমৎকার অনুবাদ হয়েছিল। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাগদাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতি এমন ইতিবাচক ছিল যে ফারাবী বেশ কিছুকাল সেখানে অবস্থান করেছিলেন এবং তিনি সেখানকার বেশ কিছু সমস্যা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদির সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। একইসাথে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছিলেন।
বাগদাদে বায়তুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা, অনুবাদের কাজ তুঙ্গে ওঠা, আব্বাসীয় শাসকদের রাজধানী বাগদাদে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পণ্ডিতদের উপস্থিতি ও তাদের তৎপরতা এই শহরটিকে ফারাবির যুগের প্রধান জ্ঞানগবেষণা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। এর ফলে মুসলিম বিশ্বের দূরদূরান্তের অঞ্চলগুলোও উপকৃত হয়। সে সময় বাগদাদ শহরের শিক্ষাকেন্দ্রগুলো ছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পণ্ডিত গবেষকদের মিলনকেন্দ্র যা মুসলিম সমাজকে শুধু ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য জাতির বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারার সাথেও পরিচিত করে তুলেছিল। এই বিষয়টি ফারাবি আমলে মুসলিম সমাজে এবং বিশেষ করে বাগদাদে এক ধরনের সহনশীলতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যা তুলনামূলকভাবে শিয়া, সুন্নি, খ্রিস্টান প্রমুখ সকল পণ্ডিত ও মানুষকে তাদের সমস্যা ও মতামত তুলে ধরার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিল। তবে, এই স্বাধীনতা ও সহনশীলতা সবসময় একই স্তরে ছিল না এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে প্রসারিত ও স্থায়ী হয়নি।
ফারাবী যুগের বাগদাদ মেসোপটেমীয় অঞ্চলের আরব সমাজ একটি ব্যতিক্রমী যুগ হিসেবে বিবেচিত হতো। কারণ এর আগের শাসকদের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে শিক্ষার তেমন পরিবেশ ছিল না এবং এরপরও অনেক দিন পর্যন্ত বাগদাদে এতোটা স্বাধীনতা অনুভূত হতো না। কিন্তু ফারাবীর যুগে বাগদাদে মত প্রকাশের খুব ভালো স্বাধীনতা ও ইতিবাচক পরিবেশ ছিল।
শিয়া ব্যক্তিরা এবং শিয়া পরিবারবর্গ যারা পূর্বে নিপীড়িত ছিল তারা আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা ছিল গুরুত্বপূর্ণ উৎস বা সহযোগী। আব্বাসিয় খেলাফতকালে বিভিন্ন ধর্ম ও মাজহাবের পণ্ডিতদের মধ্যে গঠনমূলক বিতর্ক হতো যা বাগদাদের সমাজে সহনশীলতা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল এবং এই শহরে শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানার্জনের পরিবেশকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল।
আল-ফারাবি ছিলেন ইসলামি দর্শনের অনেক বড় মাপের পণ্ডিত ও গবেষক। ইসলামি দর্শন বিকাশে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এ কারণে তার মৃত্যুর পরও মুসলিম বিশ্বের বহু মনীষী এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শনের ইতিহাসবিদদের অনেকে ইসলামি দর্শনে ফারাবির মতের প্রভাবের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ফারাবি ছিলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন যারা ইতিহাসের অত্যন্ত স্পর্শকাতর সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী চিন্তাবিদদের চিন্তাধারায় গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফারাবীর প্রভাব এতটাই বেশি যে বলা যায়, ফারাবী এবং তার চিন্তাধারা ইসলামী সভ্যতার বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ফারাবির প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল ধর্ম এবং দর্শনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন। তিনি বিশ্বাস করতেন মুহাম্মদী ধর্ম এবং গ্রীক জ্ঞানের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই এবং যদি কোন দ্বন্দ্ব কিংবা পার্থক্য থাকেও তবে তা একেবারেই বাহ্যিক যা দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। ফারাবির বেশ কিছু উপাধি রয়েছে যেমন, 'দ্বিতীয় শিক্ষক', 'ইসলামী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা' এবং 'ইসলামী বিশ্বে গ্রীক যুক্তির প্রেরণকারী'।
ফারাবির জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও দার্শনিক অবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে এটুকু বলা যথেষ্ট যে, অনেক ইতিহাসবিদ ও জীবনী লেখক তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং ডিফো-এর মতো প্রাচ্যবিদরা ফারাবিকে ইবনে সিনার থেকেও উচ্চতর স্থান দিয়েছেন। যদিও ইসলামি চিন্তাধারা ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে আল-কিন্দিকে প্রথম আরব দার্শনিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে কিন্দি কখনই দার্শনিক বিষয়ে শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি করতে সক্ষম হননি এবং একটি সুশৃঙ্খল দার্শনিক ব্যবস্থা তুলে ধরতে পারেননি। কিন্তু ফারাবী বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এই কারণে তাকে "ইসলামী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা" বলা হয়। ফারাবির জীবদ্দশায় তার সকল বন্ধু ও ছাত্র-ছাত্রীরা তার জ্ঞান সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তারা এরিস্টটলের অধিবিদ্যাকে সঠিকভাবে বুঝতে ফারাবির লেখার সহযোগিতা নিতেন।
ইবনে সিনার মতো একজন বড় মাপের দার্শনিক যখন অনেক প্রচেষ্টার পর দ্বিতীয় শিক্ষক অর্থাৎ ফারাবির লেখা "এগরজ মা বাআদ আল-তাবিয়্যাহ" বইটির সাহায্যে অ্যারিস্টটলের দর্শন বুঝতে পারতেন, তখন এটা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, ইবনে সিনার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরাও কিভাবে ফারাবি ও তার সৃষ্টিকর্মকে মূল্যায়ন করতেন এবং ফারাবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বলা যায় ফারাবির প্রেরণায় ইবনে সিনা দার্শনিক হয়ে ওঠেন। তার উত্থাপিত বেশিরভাগ সৃষ্টিকর্ম ও চিন্তাগবেষণাই ফারাবির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, এটা বলা যায় যে, ফারাবী না থাকলে আমরা দার্শনিক ইবনে সিনাকে পেতাম না। অর্থাৎ ইবনে সিনা ছিলেন ফারাবীরই অস্তিত্ব ও চিন্তাধারারই প্রতিচ্ছবি। "তাহসিল আল-সাআদাহ"সহ ইবনে সিনার লেখা বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে যা আল ফারাবির লেখা গ্রন্থসমূহের প্রায় অনুরূপ। দুজনেই এমন কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নামও প্রায় একই। যেমন 'আল-তাআলিক' গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়। ইবনে সিনা "তারকার আইনের বিলুপ্তি" গ্রন্থ রচনা করেছেন যা ফারাবীর লেখা "আমরা সঠিক এবং আমরা সঠিক নই" গ্রন্থের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ছাড়া, ইবনে সিনার "আল-সিয়াসা" ও ফারাবীর "আল-সিয়াসা" গ্রন্থ খুব কাছাকাছি।
তবে নিঃসন্দেহে ইবনে সিনা এর চেয়েও এগিয়ে ছিলেন এবং তিনি বিভিন্ন অধ্যায় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফারাবীর লেখনি ও চিন্তাধারাকে ব্যবহার করতেন। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।