নভেম্বর ২১, ২০২৩ ১৬:০৪ Asia/Dhaka

আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে মহানবী (সা.) এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা রাসূলের আহলে বাইতের প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের আনুগত্য ও তাদের অনুসরণ সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বিশ্বনবী (সা.)এর সঙ্গে ইরানি যোদ্ধাদের গভীর আত্মিক সম্পর্ক।  আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে খুব কম অভিযানই পাওয়া যাবে যার নাম রাসূলের আহলে বাইত আলাইহিমুস সালামের নামে রাখা হয়নি।  ইরানি সেনা কমান্ডাররা ইয়া রাসূলুল্লাহ, ইয়া আলী ইবনে আবি তালেব, ইয়া ফাতেমাতুজ জাহরা, ইয়া হোসেইন, ইয়া ইমাম জাফর সাদিক, ইয়া মুসা ইবনে জাফর, ইয়া জাওয়াদ আল আয়েম্মে অথবা ইয়া মাহদি বলে বড় বড় অভিযানগুলো শুরু করতেন।  ইরানি যোদ্ধারা এই আলোকজ্জ্বল নামগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের মতো আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ইরানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ডিভিশন, কোর, ব্যাটালিয়ান ইত্যাদির নাম রাখা হতো আল্লাহর রাসূল (সা.) কিংবা কোনো ইমামের নামে।  ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ ব্রিগেড, ১৭ আলী ইবনে আবি তালেব ব্রিগেড, ১০ সাইয়্যেদুশ শোহাদা ব্রিগেড,  ৪১ সারুল্লাহ ব্রিগেড, ৭ ওয়ালি আসর ব্রিগেড, ১৪ ইমাম হোসেইন ব্রিগেড, ৩৩ আল-মাহদি ব্রিগেড, ২১ ইমাম রেজা ব্রিগেড, ৮৩ ইমাম জাফর সাদিক ব্রিগেড ছিল এরকমই কিছু সেনা ইউনিটের নাম।

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় ইরান শিবিরের পতাকাগুলোতে এসব নাম লেখা থাকত। ইরানি যোদ্ধারা তাদের কপালে এসব নাম লেখা ব্যান্ড পড়তেন। তারা তাদের জীবনে আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা করতেন।  ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কারবালা বিপ্লবকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ইরানি যোদ্ধারা। যারা মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ইমামগণ গোনাহ থেকে পবিত্র এবং তাদের জীবনাদর্শ আমাদের জন্য অনুকরণীয় তারা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ওই আদর্শ ধারন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন এটাই স্বাভাবিক।  আহলে বাইতের প্রত্যেক ইমাম অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং এই প্রতিরোধের পথে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকেরা ইমামগণের সেই প্রতিরোধের কথা স্মরণ করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

ইরানি যোদ্ধাদের স্মৃতিকথা, সাক্ষাৎকার ও তাদের অসিয়তনামা পড়লে এ বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। একথা উপলব্ধি করতে মোটেও কষ্ট হয় না যে, ইরানি যোদ্ধারা মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের জীবনাদর্শ থেকে কতখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে আগ্রাসী বাথ সেনাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর রাসূল ও তাঁর আহলে বাইতের ইমামদের জিহাদের আদর্শ অনুসরণ করেছেন। আহলে বাইতের ইমামগণ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজেদের জান ও মাল আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেছেন। কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আ.) আল্লাহর জমিনে দ্বীন ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য ৭২ জন সঙ্গীসাথীসহ যেভাবে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি সৈনিকেরা সবচেয়ে বেশি স্মরণ করেছেন কারবালা প্রান্তরের অসম লড়াইয়ের কথা।

বিগত এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে কারবালা প্রান্তরের শোকাবহ ঘটনাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা বহুবার বহু জায়গায় অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের এ যুদ্ধ কারবালা প্রান্তরের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। কাজেই তাদেরকে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের মতো জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইসলামি ইরানকে রক্ষা করতে হবে। তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু দেশের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে কোনো আপোষ করতে রাজি হননি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের একের পর এক বিজয়ে কারবালার আশুরা বিপ্লব ব্যাপক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ সম্পর্কে একজন ইরানি যোদ্ধা তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ফাও দ্বীপ দখলের ‘ওয়ালফাজর-৮’ অভিযানে ইরাকি বাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে একজন সাহসী ইরানি যোদ্ধার হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি থেমে যাননি বরং বাকি এক হাত দিয়েই শত্রুকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছিলেন।  এ সময় সহযোদ্ধারা তার দিকে ছুটে আসেন এবং বলেন, তুমি এখন থেমে যাও। তোমার একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বাকি হাতটি তোমার জীবন চালাতে প্রয়োজন হবে। চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এ সময় ওই যোদ্ধা সহকর্মীদের উদ্দেশ করে বলেন: আমার হাত তে হযরত আবুল ফজলের হাতের চেয়ে মূল্যবান নয়। তিনি যেমন কারবালার ময়দানে শত্রুসেনাদের হামলায় দুই হাত হারিয়েও এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন আমিও তেমনটিই করব।

ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)ও দৃঢ়ভাবে একথা বিশ্বাস করতেন যে, যুদ্ধের ময়দানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের জীবন থেকে আদর্শ গ্রহণ করা উচিত। তিনি ইরানি যোদ্ধাদের বারবার এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মহান ইমামগণ সারাজীবনের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে যে জিনিসটি আমাদের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে গেছেন তা হচ্ছে দ্বীন ইসলাম। তিনি শোয়াবে আবু তালিবে মুসলমানদের বিরুদ্ধ কাফিরদের অর্থনৈতিক অবরোধের কথা উল্লেখ যোদ্ধাদের বলতেন তারাও যেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের ওই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে শত কষ্ট সহ্য করে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। ইমাম খোমেনী (রহ.) এ সম্পর্কে বলেন: ইসলামের স্বার্থে আমাদের যথাসম্ভব ত্যাগ স্বীকার করা উচিত। আহলে বাইতের সব ইমাম হয় তৎকালীন শাসকদের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অথবা নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন কিংবা অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকেছেন। কিন্তু তাঁরা তাদের জীবনটাকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন বলে এসব কষ্ট তাদের কাছে পানির মতো সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমরাও আজ ইসলামের জন্য যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছি তাতে যত বাধা ও কষ্টই আসুক হাসিমুখে বরণ করে নেব। ইসলাম এমন এক সম্পদ যার জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করে দেব; তাহলেই পৃথিবীর বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ