নভেম্বর ২১, ২০২৩ ১৬:১৬ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে মহানবী (সা.) এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের অনুরাগ ও আনুগত্য নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরাকি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সঙ্গে ইরানি যোদ্ধাদের গভীর আত্মিক সম্পর্ক। ওই একই সূত্রে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইমাম খোমেনীর সঙ্গে ইরানি যোদ্ধাদের আত্মিক ও আবেগঘন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বেলায়েতে ফকিহর প্রতি বিশ্বাস ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইরানের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। আর ইমামের বিচক্ষণ নেতৃত্ব যে ওই যুদ্ধে ইরানকে বিজয় এনে দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। ইমাম খোমেনী যখনই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিতেন তখনই হাজার হাজার তরুণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হতো। ইমাম যখনই শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাতেন তখনই ইরানের সেনাবাহিনী, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী ইমামের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। 

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীদের পর ইসলামের ইতিহাসে আর কখনও নেতার প্রতি এমন আনুগত্যের নজির পাওয়া যাবে না যা পাওয়া গেছে ইমাম খোমেনীর অনুগত ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে। যোদ্ধাদের সংখ্যা ও আনুগত্য উভয় দিক দিয়ে ইসলামের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। ইরানি যোদ্ধারা যে শুধু সচেতনভাবে ইমামের আনুগত্য করতেন তা নয় একইসঙ্গে তারা ইমাম খোমেনীকে অনুসরণযোগ্য আদর্শ বলে মনে করতেন। তারা ইমামের ঈমানি শক্তি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করতেন এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট ইরাকের বাথ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অটল ও অবিচল থাকার জন্য ইমাম খোমেনীর স্থিরচিত্ত মনোভাব থেকে দীক্ষা নিতেন। ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে তার ভাষণ একবার শোনার পর দীর্ঘদিন আগ্রাসী ইরাকের বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা ধরে রাখতে পারতেন ইরানি যোদ্ধারা। 

ইরানি যোদ্ধারা ফ্রন্ট থেকে তাদের পরিবারের কাছে যেসব চিঠি লিখতেন এবং শহীদ ইরানি যোদ্ধারা যেসব অসিয়তনামা লিখে রেখে গেছেন তাতে ইমামের প্রতি আনুগত্যের এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি সৈনিকদের সংগঠন ‘বুনিয়াদে ইসারগারানের’ সাবেক পরিচালক মোহাম্মাদ আলী রাহিমিয়িান ইরানি শহীদদের সংখ্যা নিয়ে একটি গবেষণাকর্মের ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন: প্রতিটি অসিয়তনামায় গড়পরতা চারবার বেলায়াতে ফকিহ হিসেবে ইমাম খোমেনীর আনুগত্য করাকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একজন শহীদ তার অসিয়তনামায় লিখেছেন: 

“আমার যুদ্ধে আসার প্রথম কারণ, হযরত ইমাম খামেনেীর ডাকে সাড়া দেওয়া। আমি এক্ষেত্রে বেলায়েতে ফকিহর আনুগত্য এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কারণ, বেলায়েতে ফকিহ তথা ইমাম খোমেনীর প্রতি আনুগত্য বিশ্বনবী (সা.)-এর আনুগত্যের সমতুল্য।”বেলায়েতি ফকিহর প্রতি বিশ্বাস এবং ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বের প্রতি অগাধ আস্থা ইরানি যোদ্ধাদের অন্তরে এত বেশি রেখাপাত করেছিল যে, ইরাকি বন্দিশিবিরে চরম নির্যাতনের মধ্যেও কোনো ইরানি যোদ্ধা মুক্তি পাওয়ার আশায় ইমাম খোমেনীর অবমাননা করতে রাজি হতো না। 

ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির সংবাদদাতার এক প্রশ্নের উত্তরে ইরাকিদের হাতে আটক একজন ইরানি কিশোর বলেন, “ইমাম খোমেনী আমার নেতা। তিনি যে আদেশ দেবেন আমরা তা মাথা পেতে নেব। তিনি বলেছেন যুদ্ধে যেতে তাই আমরা যুদ্ধে এসেছি।” একবার ইরাকি কারারক্ষীরা ইমামকে গালি দিতে একজন কিশোরের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ওই কিশোর অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে উত্তর দেয়: “তোমরা তোমাদের নেতাকে সম্মান করো কি করো না তা দেখার প্রয়োজন আমার নেই। তবে আমি আমার নেতাকে সম্মান করি এবং তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত রয়েছি। কোনো অবস্থায়ই আমি তার অবমাননা করতে পারব না। ”

আরেকবার ইরাকিদের হাতে আটক একজন ইরানি পাইলটকে প্রশ্ন করা হয়, ইমাম খোমেনী তোমাদের এমন কি উপকার করেছে যে, তোমরা তাকে এত ভালোবাসো? উত্তরে ইরানি পাইলট বলেন: “দেশের স্বাধীনতা অর্জন, বিদেশিদের দেশ থেকে বের করে দেওয়া, বিশ্বাসঘাতক শাহ সরকারকে উৎখাত করা, অপবিত্রতা ও অশ্লীলতার কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া এবং ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কি তাঁকে ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট নয়? এসবের বাইরেও তিনি একজন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন এবং অনুকরণীয় ফকিহ। ইরানের বেশিরভাগ নাগরিক শিয়া এবং তারা কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন ছাড়াই তার নির্দেশ পালন করে।” ওই পাইলট আরো বলেন, “ইরানি জনগণ ইমাম খোমেনীর শাসনকে আল্লাহ প্রদত্ত শাসন মনে করে। শুধু আমি নই গোটা ইরানবাসী ইমামের জন্য পাগলপারা।”

আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা তাদের লক্ষ্যের প্রতি অটল ও অবিচল ছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই যুদ্ধে তারা আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন বলে তারা সঠিক পথে রয়েছেন এবং ইরাকি বাহিনী আগ্রাসন চালিয়েছে বলে তারা বাতিল শক্তি। ইরানি যুবকেরা জানতেন তারা নিজেদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করছেন এবং ইরাকিরা ইরানের কাছ থেকে ইসলামি বিপ্লবকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইরানি যোদ্ধারা নিজেদের সম্মান, বিপ্লব ও স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। দেশ রক্ষার জন্য ইরানি যোদ্ধাদের যে পরিমাণ উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল ইরাকি বাহিনী ছিল ততটা ক্লান্ত ও লক্ষ্যহীন।  এ কারণে সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও মানসিক শক্তিতে ইরানি যোদ্ধারা ছিলেন পর্বতসহ উচ্চতায় সমাসীন। 

ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) বারবার এ বিষয়টি জোর দিয়ে উল্লেখ করতেন যে, আমরা আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করছি এবং শত্রু  আমাদের দেশের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে। কারো সঙ্গে যুদ্ধ করার অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। কিন্তু কেউ আগ্রাসন চালালে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মতো জাতি আমরা নই।  ইমাম খোমেনী আরো বলেন: ইসলাম রক্ষা করার জন্য আমাদেরকে আত্মরক্ষা করতে হবে। ইসলামি ভূখণ্ড রক্ষা করার জন্য আমাদেরকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ওরা আগ্রাসন চালিয়ে আমাদের শহর ও গ্রামগুলো দখল করে নিয়েছে এবং নাশকতা চালাচ্ছে। এই শয়তানের হাত থেকে বিশ্ব মুসলিমকে রক্ষা করা এখন আমাদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা তাদের দেশে আগ্রাসন চালাইনি যে, আমাদেরকে অপরাধবোধে পেয়ে বসবে। যারা আমাদের দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে তারা অপরাধী। কারো বাড়িতে যদি চোর আসে এবং বাড়ির মালিক যদি চোরকে ধরে মেরে ফেলে তাহলে গৃহকর্তা অপরাধী নাকি চোর অপরাধী? গৃহকর্তার তো কোনো দোষ নেই, তার ঘরে চোর ঢুকেছে এবং তিনি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে চোরের ওপর হামলা করেছেন এবং চোর ভবলীলা সাঙ্গ করেছে। এমনকি গৃহকর্তার যদি জানা থেকে যে তাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে তারপরও সে চোরের ওপর হামলা করবেই। কারণ এখানে সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন জড়িত। ইমাম খোমেনী আরো বলেন, আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ করছি। এর অর্থ হচ্ছে আমরা ইসলাম এবং একটি মুসলিম ভূখণ্ডের সম্মান রক্ষা করছি। এটি এমন এক প্রতিরক্ষা যুদ্ধ যা ইসলাম ও বিবেক উভয়ে সমর্থন করে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#
 

পার্সটুডে/এমএমআই/ এমবিএ/২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ