নভেম্বর ২২, ২০২৩ ১৫:১৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে মহানবী (সা.) এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের অনুরাগ ও আনুগত্য নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ ছিল এমন একটি সংঘাত যা ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরানের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে নিজের আগ্রাসী নীতি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়ে ওই যুদ্ধের জন্য ইরানকে দায়ী করার চেষ্টা শুরু করে বাগদাদ। এ কারণে ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধ করার যেকোনো পরিকল্পনা উত্থাপিত হলেই তেহরানের পক্ষ থেকে ওই যুদ্ধ বাধানোর জন্য দায়ী দেশকে চিহ্নিত করার ওপর জোর তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সাদ্দামের পৃষ্ঠপোষকরা ইরানের এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল এ কারণে যে, তারা যাতে বাদগাদের প্রতি তাদের সামরিক সহায়তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে।

পক্ষান্তরে ইমাম খোমেনী (রহ.) তার যুক্তিপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, ইরান এ যুদ্ধ শুরু করেনি বলে তা বন্ধ করার দায়িত্বও তেহরান নেবে না। ইরানি জনগণ কেবল তাদের মাতৃভূমি রক্ষার করার জন্য যুদ্ধে জড়িয়েছে।  তিনি এ সম্পর্কে এক ভাষণে বলেন: “ইরানের সামরিক ও বেসামরিক নির্বিশেষে দেশের সকল জনগণকে দেশরক্ষায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমাদের কাছে ইসলাম রক্ষার যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ইসলাম, মাতৃভূমি ও ইসলামি ভূখণ্ড রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে দেশের সকল নাগরিককে জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।...”

ইমাম খোমেনী আরো বলেন: “...দেশ রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের। যার যে শক্তি আছে তা নিয়েই দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ইসলাম এবং ইসলামের বিধান রক্ষা করা এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, বহু নবী-রাসূল ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসেও নবীজীর জীবদ্দশা থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগে বহু মুসলিম নেতা ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন।” ইমামের এই বক্তব্য ইরানের সকল নাগরিকের হৃদয় স্পর্শ করে। তারা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠেন। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সারাদেশের তরুণ ও যুবক শ্রেণির মধ্যে সাড়া পড়ে যায়।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের দিনগুলোতে ইরান সরকারও মনে করত, তারা প্রাচ্য, দ্বীন, বিপ্লব, স্বাধীনতা ও ইসলামি ভূখণ্ড রক্ষা করার জন্য ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শুরুর দিকে দেয়া এক ভাষণে বলেন: “আমরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক জুলুমের অবসান চাই। ইসলাম আমাদের যা শিখিয়েছে তা হলো- লা তাযলিমুনা ওয়ালা তুযলামুন। অর্থাৎ, তোমরা যেমন জুলুম করবে না তেমনি কারো জুলুম বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে না। ইরাক আমাদের ওপর যে জুলুম চাপিয়ে দিয়েছে আমরা তার অবসান চাই। আমরা এমন জাতি নই যে, কোনো বিদেশি চাপে ভয় পাবো কিংবা চাপের কাছে নতিস্বীকার করব। ...।”

তিনি আরো বলেন, “...আমাদেরকে আমাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। আজ যদি আমরা নিজেদের অধিকার রক্ষা না করি এবং শত্রুকে তার জায়গায় ফেরত না পাঠাই তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ইসলামি বিপ্লব আমাদের কাছে এই প্রত্যাশা করতেই পারে যে, এই বিপ্লবের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দেই।” আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী আরো বলেন, “এই যুদ্ধের একপক্ষে রয়েছে একদল মুমিন বান্দা যারা মনে করছে তাদের বিপ্লব ও সম্মান কেড়ে নিতে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। তারা তাদের বিপ্লব, সম্মান ও ধর্ম রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছে। যুদ্ধের অন্য পক্ষে রয়েছে বস্তুবাদী একদল বেঈমান যারা আমাদের দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে; যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যাদের উৎসাহ বা উদ্দীপনা নেই।”

উৎসাহ, উদ্দীপনা বা অনুপ্রেরণা যেকোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের মনোবল তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর এই দিক দিয়ে ইরাকি সেনাদের তুলনায় ইরানি সৈনিকেরা বহুগুণে এগিয়ে ছিলেন। ইরানের তৎকালীন পার্লামেন্ট স্পিকার ও সশস্ত্র বাহিনীর উপ প্রধান আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি এ সম্পর্কে বলেন: “আমাদের সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা রাখা আমাদের প্রধান কাজ। আমাদের যোদ্ধারা জানে যে, তারা কেন যুদ্ধ করছে। তারা যুদ্ধ করছে তাদের দেশ থেকে আগ্রাসী বাহিনীকে বিদায় করার জন্য।” বিষয়টি আরো ভালো করে উপলব্ধি করার জন্য আমরা সরাসরি ইরানি যোদ্ধাদের ভাষ্য শুনতে পারি।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ফ্রন্ট লাইন থেকে একজন ইরানি সৈনিক তার মাকে উদ্দেশ করে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন: মা আমর! তোমাকে অসন্তুষ্ট করে যুদ্ধে আসার কারণ জানলে তুমি আর অসন্তুষ্ট থাকতে পারবে না। একদল ডাকাত আমাদের দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে, বহু মানুষকে হত্যা করেছে, সীমান্তবর্তী ঘরবাড়ি লুট করেছে, নারীদের সম্মানহানি করেছে, আমাদের এক হাজার ৫০০ গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমি কী করে ঘরে বসে থাকি? কীভাবে আমি এত বড় অত্যাচার ও আগ্রাসন মেনে নিতে পারি? এই আগ্রাসন মেনে নেয়া কি জুলুমের নামান্তর নয়?

একজন ইরানি শহীদ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়ার আগে নিজের অসিয়তনামায় লিখে গেছেন: “আমরা কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসলাম ও কুরআনকে রক্ষা করছি। এই যুদ্ধে সামান্যতম শীথিলতা দেখালে তার জন্য অনেক বেশি পস্তাতে হবে।  একজন ইরানি তরুণকে তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হবে। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে যাতে চূড়ান্ত বিজয় হাতে এসে ধরা দেয়।”

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরেকজন শহীদ তার অসিয়তনামায় লিখে গেছেন: হে আল্লাহ তোমার অসংখ্য শুকরিয়া যে, তুমি আমাকে সত্যের পথে অবিচল রেখেছো এবং তুমি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করার সুযোগ দাওনি। তুমি তোমার নির্দেশ অনুযায়ী আমাদেরকে জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছো। আমরা যেন কারো প্রতি জুলুম না করি। আর যে যুদ্ধটি আমরা শুরু করিনি বরং আমরা ইসলাম রক্ষা করতে ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সামনে মাথানত না করতে যুদ্ধ এসেছি।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

 

ট্যাগ