নভেম্বর ২২, ২০২৩ ১৬:১১ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর প্রতি ইরানি যোদ্ধাদের অনুরাগ ও আনুগত্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইরানি যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাদায়ক শক্তি নিয়ে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধারা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমি মুক্ত করার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করার সময় এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে বুকে ধারণ করতেন যে, এ যুদ্ধে তারা মহান আল্লাহর সাহায্য পাবেন।  ইরানের পাল্টা হামলায় পর্যুদস্ত হয়ে ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম হোসেন যখন পরাজয়ের মুখোমুখি হন তখন তিনি ইরানে আগ্রাসন চালানোর পক্ষে ধর্মীয় কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি দাবি করেন, ইরান আগে তার দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং ইরাক এ যুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে রয়েছে। তিনি এমন সময় এ দাবি করেন যখন বাস্তবতা ছিল ঠিক তার উল্টো।

এছাড়া, তার নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বাথ পার্টির মেনিফেস্টো অনুযায়ী, ধর্মীয় কোনো স্লোগান দেওয়ার কোনো সুযোগ তার ছিল না। বরং সাদ্দাম ছিলেন প্রচণ্ড ইসলামবিরোধী এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের বিপক্ষে তিনি প্রকাশ্যে কথা বলতেন। সাদ্দাম ইরাকের বহু আলেমকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। ইরাকের সাবেক এই শাসক দেশটির নাজাফ, কারবালা, কাজেমাইন ও সামেরা শহরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদের মাজারগুলো বন্ধ করে দেন। ১৯৯০ সালে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের গণজাগরণ দমন করার সময় সাদ্দামের নির্দেশে নাজাফ শহরে হযরত আলী (আ.) এবং মাজার এবং কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাজারে কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়। কাজেই সাদ্দাম নিজেকে মুসলমান দাবি করে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলার যে বক্তব্য দেন মুসলিম জনমতকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

এর বিপরীতে ইরানি যোদ্ধারা ছিলেন গভীর ঈমানের অধিকারী এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতের প্রদর্শিত পথের অনুসারী। ইরানি যোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক ছিলেন একজন উঁচু স্তরের আলেম এবং মহান ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)। ইরানের শহীদ যোদ্ধারা তাদের ওসিয়তনামায় সুস্পষ্টভাবে লিখতেন যে, তারা কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তারা একথা বলে গিয়েছেন যে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের উস্কানিতে ইরাকি শাসক সাদ্দাম ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ইরানে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন। একজন ইরানি যোদ্ধার অসিয়তনামায় তার বক্তব্য এসেছে এভাবে: “এই যুদ্ধ ক্ষমতা বা সম্পদ লাভের নেশায় শুরু হয়নি। বরং এটি হচ্ছে বাতিলের বিরুদ্ধে হকের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের এক পক্ষে রয়েছে এ যুগের ইমাম হোসেইনের সহযোগীরা এবং অপর পক্ষে রয়েছে বর্তমান যুগের এজিদি বাহিনী।”

ইসলামি শিক্ষায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ইরানি যোদ্ধারা বিশ্বাস করতেন এ যুদ্ধে তারা ঐশী মদদ লাভ করবেন। তারা মনে করতেন, যুদ্ধে তারা এমন অদৃশ্য সাহায্য লাভ করবেন যা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ইরানি যোদ্ধাদের বিশ্বাস ছিল, মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে থাকেন। এর একটি হচ্ছে ‘আম সাহায্য’ বা গণসাহায্য। এই সাহায্য আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে উৎসারিত এবং মুমিন ও কাফির নির্বিশেষ সব মানুষ ও প্রাণী এই সাহায্য লাভ করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগতের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এসব সৃষ্টির প্রতি তাঁর রহমতের বারিধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ হবে এসব সৃষ্টির ধ্বংস হয়ে যাওয়া। কিন্তু তা কিয়ামতের আগে সম্ভব নয় বলে সব সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর রহমত রয়েছে।

দ্বিতীয় ধরনের সাহায্য হচ্ছে গায়েবি বা অদৃশ্য সাহায্য। এটি কিছু বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ তায়ালার বিশেষ এই রহমত শুধুমাত্র মুমিন ব্যক্তিরা লাভ করেন এবং কাফিররা এই রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। মুমিনদের তাকওয়া, খাঁটি ঈমান এবং আল্লাহর রাস্তায় তাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফল হিসেবে তারা এই রহমতের বারিধারায় সিক্ত হতে পারেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে, সূরা আনকাবুতের ৬৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন: যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গেই থাকেন।” আর তৃতীয় ধরনের অদৃশ্য সাহায্যের নাম ‘খাছ’ সাহায্য।  এই সাহায্যটির একমাত্র ভাগীদার মুজাহিদ বা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুমিনগণ। আল্লাহ তায়ালা সূরা মুহাম্মাদের ৭ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলেছেন: “হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাসমূহ সুদৃঢ় করবেন।”

মক্কার কাফির ও মদীনার ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াইকারী মুমিন মুসলমানদেরকে আল্লাহ তায়ালা নানাভাবে সাহায্য করেছেন। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে এসব সাহায্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ কাফিরদের মোকাবিলায় মুমিনদের অন্তর প্রশান্ত ও শক্তিশালী করে দেন যাতে তারা দৃঢ়পায়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন। আর এরকম অবস্থায় মুসলিম যোদ্ধাদের সাহায্যে সরাসরি ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করেন আল্লাহ তায়ালা। পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, বদর যুদ্ধের পাশাপাশি আহজাব ও হুনাইনের যুদ্ধে ফেরেশতারা সরাসরি মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। ফেরেশতারা কাফিরদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি দেখিয়েছিলেন এবং মুমিনদের চোখের সামনে কাফিরদের সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়েছিল। বদরের যুদ্ধে এই প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা বিজয় লাভ করেন।

কোনো কোনো ঐশী মদদ এসেছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় রূপে। বদরের যুদ্ধ শুরুর আগে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে মুসলিম যোদ্ধাদের পায়ের নীচের বালু ভিজে গিয়ে তাদের চলাচলে সুবিধা হয়েছিল। অন্যদিকে কাফিররা যেখানে ছিল সেখানে ছিল এটেল মাটি যা বৃষ্টির ফলে এত বেশি কাদায় পরিণত হয়েছিল যে, কাফিরদের পক্ষে নড়াচড়া করাই মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। আহজাবের যুদ্ধে শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড় আসায় কাফিররা মদীনার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার ঐশী সাহায্য কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।  কাজেই দেখা যাচ্ছে, মুমিনদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য একটি চিরায়ত রীতি। উপযুক্ত প্রেক্ষাপট থাকলে সকল যুগে সকল স্থানে আল্লাহর এই রীতি কার্যকর হয়। ইরাকের আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধারা বহুবার এ ধরনের ঐশী সাহায্য উপলব্ধি করেছিলেন। ইরানি যোদ্ধারা এই সাহায্য চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং তাদের বর্ণনায় ঐশী সাহায্যের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরে আমরা ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরানি যোদ্ধাদের প্রতি ঐশী সাহায্যের কিছু উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ এমবিএ/  ২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ