ডিসেম্বর ০৬, ২০২৩ ১০:০৩ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান আলাপনে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি ভালো আছেন। বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

২০২৪ সালের সেই ভোট নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, সমালোচনা, বিরোধীতা, আন্দোলন সংগ্রাম, হরতাল অবরোধ। তো আমরা এ প্রসঙ্গ নিয়েই আজ কথা বলব। আর আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন-সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান।

সাংবাদিক ইলিয়াস খান বললেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদৌ বাংলাদেশে নির্বাচন হবে কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। ২০১৪ ও ২০২১৮ সালের পরিস্থিতি ছিল একরকম। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।

তিনি আরও বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার যদি গায়ের জোরে নির্বাচন করে ফেলতে চায়  সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন থেকে অথবা নির্বাচনের পর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। যদিও আমরা সেটি চাই না। নিষেধাজ্ঞা এলে দেশের জন্য সেটি ভালো হবে না। কারণ দিনশেষে দেশটি আমাদের সবার।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

জনাব ইলিয়াস খান, রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান:  জনাব ইলিয়াস খান, বাংলাদেশে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে কিন্তু বিএনপিসহ বহু বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তাতে কী আগামী নির্বাচন সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারবে বলে মনে হয় আপনার?

বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন

ইলিয়াস খান: আপনাকে ধন্যবাদ এবং যারা এ অনুষ্ঠান সবাইকে ধন্যবাদ। দেখুন আপনি নির্বাচন সুষ্ঠু কিংবা অসুষ্ঠু হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। আমি বলছি আদৌ নির্বাচন হবে কি না সে প্রশ্ন কিন্তু আছে! কারণ বিএনপিসহ বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক দলগুলো রয়েছে, যারা  দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করছে। দেশের মানুষের ভোটাধিকার, মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করছে তারা। তারা তো এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তারা নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে এবং আমি মনে করি তারা সফল হবে। এই কারণে মনে করি যে, সাম্প্রতিক সময়ে আপনি দেখবেন আন্দোলন সংগ্রামে শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীই নয় সাধারণ মানুষও যোগ দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ কথা বলতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় নির্বাচনটি আদৌ হবে বলে আমি মনে করিনা। নতুন করে তফসিল ঘোষণা করে সকল গণতান্ত্রিক  দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আমি আশা করি।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা, এসব দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে নির্বাচন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তখন কী হবে? অবশ্য ২০১৪ বা ২০১৮ সালে একই প্রশ্ন ছিল কিন্তু সরকার মেয়াদ পূরণ করেছে।

ইলিয়াস খান: দেখুন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ঠিকই। তবে এবার ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অবস্থাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত দুটি নির্বাচনের সময় বিএনপিসহ দুই একটি দল নির্বাচনে যায়নি। এবারের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্প্রতিকালে চরমোনাই পীর সাহেবের একটি প্রোগ্রাম দেখলাম। সেখানে ডান-বামসহ সকল মতপথের লোক জড় হয়েছিল। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণা দিয়েছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই কেবল তারা নির্বাচন করবে-অন্যথায় না। আর এর আগের দুটি নির্বাচন কিন্তু সারাবিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যবস্থার যেকোনো কারণে সেই দুটি নির্বাচন টিকে গেছে। ২০২৪ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি গোটা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য কাজ করছে। আমাদের এ অঞ্চলেও কিন্তু তাদের ভূমিকা রয়েছে।

(প্রতীকী ছবি)

আপনি লক্ষ্য করবেন কর্তৃত্ববাদী দেশগুলো যেখানে নির্বাচন হয় না সেসব দেশ কিন্তু আমাদের বিনাভোটের সরকারের পক্ষ নিয়েছে। আপনি দেখবেন রাশিয়া, চীন-এসব দেশ কিন্তু এই সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশ কিন্তু সমর্থন জানাচ্ছে না। যদিও বলা হচ্ছে ভারত আমাদের বর্তমানে যে সরকার আছে তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে কিন্তু সেটিও খুব জোরালো বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না। কারণ ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে ভূ রাজনৈতিক কারণে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতের একেবারে বারে গিয়ে ভারত একেবারে এই সরকারকে চাইবে সে সুযোগ কিন্তু কম। আর সাম্প্রতিকালে ভারতের পত্রপত্রিকার পাতার বিভিন্ন লেখায় সেগুলো ফুটে উঠেছে। ভারতের প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথে কিন্তু তাদের এখন ভালো সম্পর্ক নেই। আর এ বিষয়টি ভারত নিঃসন্দেহে বিবেচনা করবে বলে আমি মনে করি। সুতরাং সরকার যদি গায়ের জোরে ২০১৪ ও ২০১৮ যেমনটি গায়ের জোরে নির্বাচন করেছিল এবারও তেমনটি করতে চায় তাহলে সেটি আন্তর্জাতিক মহলে এবার স্বীকৃতি পাবে তেমন সম্ভাবনা আছে বলে আমি মনে করি না। আমি আবারও বলছি দলীয় সরকারের অধীনে আদৌ নির্বাচন হবে বলে আমি মনে করি না।

শ্রোতাবন্ধুরা! বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ৭ ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে সাংবাদিক  ইলিয়াস খানের সাক্ষাৎকার শুনছি। ফিরছি শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: ইলিয়াস খান, বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে আমেরিকা শক্ত অবস্থান নিয়েছে এবং তারা এর ধারবাহিতায়  বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। আজকাল খুব জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কথা । আপনার কী মনে হয় বাংলাদেশ এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে যাচ্ছে?

ইলিয়াস খান: দেখুন, সেই শঙ্কা একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি আওয়ামীপন্থি একজন বুদ্ধিজীবীর লেখা পড়েছি। সেখানে লেখা হয়েছে নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে-এর আগে বাংলাদেশে যখন ক্রসফায়ারসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছিল তখন র‍্যাবসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।  আর সেটি কিন্তু সাথে সাথেই টনিকের মতো কাজ করেছে। এখন কিন্তু ক্রসফায়ার হচ্ছে না। তবে নিষেধাজ্ঞার যে কথাটি আপনি বলেছেন সেটি হলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিরাট দুর্ভোগের কারণ হবে। আমরা নিশ্চয়ই চাইনা যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসুক। কারণ দিনশেষে গিয়ে এই দেশটি কিন্তু আমাদের সকলের। আমরা যে যে দলই করি না কেন দেশটি আমাদের সকলের। তারপরও আপনার প্রশ্নটিকে আমি একদম উড়িয়ে দিচ্ছি না।

আমেরিকা কিন্তু খোলা মেলাই বলেছে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। তারা একথা বলার কারণ হচ্ছে গত দুটি নির্বাচন ছিল একেবারেই প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় দেড় শতাধিক আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। ২০২৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছিল। আমার আওয়ামী লীগের বন্ধুরা বলতে চান-এর কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু বিষয়টি সারা বিশ্ব এখন জানে। সুতরাং এগুলো করে পার পাওয়া যাবে না। গায়ের জোরে যদি এমনটি করতে চায় হয়তো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার এমনটি করতে পারে। তারা মনে করে  যাইহোক না কেন আমি ক্ষমতায় থাকব। তারা এটি চায় কারণ হচ্ছে যে, তারা গত প্রায় পনের বছরে এত দুঃসহ দুর্বিনীত শাসন চালিয়েছে যদি সেই শাসনের অবসান ঘটে তাহলে তারা জনরোষের মধ্যে পড়বে। সেই ভয়ের মধ্যে তারা আছে। সুতরাং এই ধরনের একতরফা নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব না। আর যদি সেটা তারা করে ফেলতে চায় তাহলে নিষেধাজ্ঞা এর আগেও হতে পারে নির্বাচনের দিন বা নির্বাচনের পরেও হতে পারে। সেটি বিরাট জন দুর্ভোগের কারণ হবে।

রেডিও তেহরান: জনাব ইলিয়াস খান, সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা এতটা বেশি জড়িয়ে পড়ল কেন? আসলে তাদের এখানে স্বার্থটা কী?

ইলিয়াস খান: দেখুন ২০২০ সালে নির্বাচনে মি. জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল বিশ্বের যেখানেই গণতন্ত্রের অবমূল্যায়ন হবে সেখানে হস্তক্ষেপ করবে। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গণতন্ত্রের প্রশ্নে তিনি হস্তক্ষেপ করেছে। হয়তো অনেক বলতে পারেন এতে মার্কিনিদের কি আসে যায়! অবশ্য আসে যায় । কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে যে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে সেটি মূলত মার্কিন জনগণের পয়সা। আর তাদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় যে কোন দেশে কাদের তুমি সাহায্য দিচ্ছ। এ বিষয়টির সাথে সাথে রয়েছে ভূ রাজনৈতিক কিছু কারণ।

ম্যাথিউ মিলার

আপনারা জানেন যে বঙ্গোপসাগার এলাকায় চীন প্রভাব বিস্তার করতে চায়। আর সেটিকে ঠেকানোর জন্য আমেরিকার কাছে বাংলাদেশ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। আর সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে বাংলাদেশকে তার পক্ষে রাখতে চায়। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও তার সখ্যতা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মোড়ল। বিভিন্ন কারণে যেসব দেশ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেসব দেশে কিন্তু তারা তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চায় এবং তাদের পছন্দ মতো সরকার সেখানে দেখতে চায়। তাদের দেশে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে সেই ব্যবস্থাটাই কিন্তু তারা ঐসব দেশে দেখতে চায়। সুতরাং এ দুটি বিষয়ের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখছে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব ইলিয়াস খান বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নরম-গরম যেসব কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা, আন্দোলন সংগ্রাম হচ্ছে এবং কি হতে যাচ্ছে আসলে –সে সম্পর্কে রেডিও তেহরানের আলাপনকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ইলিয়াস খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/জিএআর/৬

ট্যাগ