ডিসেম্বর ২১, ২০২৩ ১১:৪৯ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। তোমাদের ভালোলাগাকে আরও বাড়িয়ে দিতে সপ্তাহ ঘুরে আবারও হাজির হয়েছি আমি গাজী আবদুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকছে একটি দাম্ভিক বাঘের গল্প। গল্পটি লিখেছেন, বাংলাদেশের  কবি, কথাশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক জাকির আবু জাফর। গল্পের পর থাকবে একটি কবিতা ও একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

একটি ঘন সবুজ বন। বনটি বড়ই সুন্দর। গাছগাছালিতে ভরা। পশুপাখি ও পতঙ্গের বিচিত্র বিচরণ সর্বত্র। সবাই আনন্দে যে যার মতো বসত করছিল। পশু পাখি ও প্রাণীদের মনে সে কি আনন্দ! কেউ কাউকে ঘাঁটায় না। কারো ওপর কেউ খবরদারি করে না। কারো অধিকার নষ্ট করে না কেউ। চলাফেরায় কেউ কাউকে বাধা দেয় না। এক কথায় বনের সব অধিবাসী স্বাধীন। যে যার পরিবার নিয়ে সুখে জীবন যাপন করছিল।

একদিন হঠাৎ বনের ভেতর ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা গেল। গর্জন শুনে বনের অধিবাসী সবার বুক কেঁপে উঠল ভয়ে। ভীত সন্ত্রস্ত বনের বাসিন্দারা। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, এ কিসের গর্জন? বনের সবচেয়ে চালাক প্রাণী শেয়াল বলল, এ যে বাঘের গর্জন।

বাঘের নাম শুনে ভয় বেড়ে গেল সবার। ভয়ে ভয়ে শেয়ালকে জিজ্ঞেস করল: এমন ভয়ঙ্কর হুঙ্কার কেন দিচ্ছে বাঘটি?

শেয়াল বলল, ‘বাঘ নিজেকে এ বনের রাজা ঘোষণা করেছে।’

এ কথা শুনে থরথর করে কাঁপছিল ছোট প্রাণিকুল। বড় প্রাণীরা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, শেয়াল ভাই বনের রাজা তো সিংহ। আমাদের এখানে বাঘ কেন?

বুদ্ধিমান শেয়াল বলল, হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই বলেছ। বনের রাজা সিংহ। কিন্তু এ বনে কোনো সিংহ নেই। তাই বাঘ নিজেকে নিজেই রাজা ঘোষণা করেছে। কারো সমর্থন নেয়নি। কাউকে জিজ্ঞেসও করেনি। কোনো নিয়ম মানার প্রয়োজনও মনে করেনি।

এদিকে বনের নব্য রাজা বেজায় অহঙ্কারী; ভীষণ দাম্ভিক। কারো কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। কারো পরামর্শও শুনতে চায় না। কেবল তার কথা-ই কথা। আর কারো কথা চলবে না। তার হুকুমই হুকুম। আর কারো হুকুম চলবে না। সে যা বলবে, তা-ই আইন। তা-ই নিয়ম। এর অন্যথা হলে শাস্তি। সে ঘোষণা করে দিলো- বনের সব অধিবাসীকে রাজার হুকুম মানতে হবে।

রাজা কয়েকটি ফরমান জারি করল। প্রথম ফরমান হলো, এ বনে রাজার পূর্বপুরুষ বাস করত। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে বনটির মালিক সে। দ্বিতীয় ঘোষণা হলো, বন থেকে কেউ কোথাও যেতে হলে বা বনে নতুন কেউ আসতে হলে রাজার অনুমতি লাগবে। অনুমতি ছাড়া বনের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়া আসা চলবে না।

আরেকটি ঘোষণা হলো, ‘রাজা নিজে আর শিকার ধরার পরিশ্রম করবে না। বনের অধিবাসীদের একেক দিন একেকটি প্রাণীকে রাজার আহারের জন্য হাজির হতে হবে।’ সেটিকেই খেয়ে নেবেন রাজা। এসব ফরমানের বিরুদ্ধে কারো কোনো কথা চলবে না। যদি কেউ বলে তবে রাজদ্রোহী হিসেবে তার কঠিন শাস্তি হবে।'

এমন ভয়াবহ ঘোষণা শুনে বনের পশুরা ভয়ে কাতর হয়ে উঠল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করল না। প্রতিবাদ করার সাহসও করল না। ফলে রাজা হয়ে উঠল মহারাজা। রাজা মশাই একটি বড় বৃক্ষের ছায়ায় আরাম করে শুয়ে বসে থাকেন। একেক দিন একেকটি প্রাণী কাঁপতে কাঁপতে এসে হাঁটু গেড়ে বসে রাজার সম্মুখে। খুব মজা করে খেয়ে আরাম করে ঘুম দেন রাজা সাহেব। আহা কী সুখ! একেবারে হাত-পা ছেড়ে ছুড়ে গড়াগড়ি খান রাজা। আয়েশে গায়ে চর্বি বেঁধে গেল বেশ।

রাজার আদেশ কিছুদিন সবাই মেনে চলল। কিন্তু হঠাৎ রাজা দেখল, কোনো প্রাণী আর আসছে না তার কাছে। একদিন গেল। দুদিন গেল। এমনকি তৃতীয় দিনও চলে গেল। কোনো পশুই এলো না। ক্ষুধায় কাহিল অবস্থা। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু অহঙ্কারী রাজা তবুও নিজে শিকার ধরে খাবে না।

হঠাৎ দেখলো রাজা, তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটি শেয়াল। শেয়ালকে যেতে দেখে রাজা চিৎকার দিয়ে বলল, এই শেয়াল! তিন দিন ধরে আমার কাছে কোনো পশু আসেনি। তাড়াতাড়ি আমার জন্য শিকার পাঠাও। নইলে কিন্তু আমি তোমাকেই খেয়ে ফেলব।

কাঁচুমাচু করে শেয়াল বলল, মহামান্য রাজা আপনি তো তিন দিন খাননি। কী ভীষণ ক্ষুধাই না লেগেছে আপনার! আহা রে, আপনার মুখ শুকিয়ে উঠেছে। গায়ে মাংস কমে গেছে। এখন যে, তীব্র ক্ষুধা আপনার আমার মতো সামান্য প্রাণীকে খেলে আপনার ক্ষুধা তো যাবেই না; বরং ক্ষুধা বেড়ে যাবে আরো! আমি একটি ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি, যদি আপনি অনুমতি দেন মহারাজ। এতে আপনি খেয়ে তৃপ্ত তো হবেনই; সেই সাথে তিন চার দিন ধরে খেয়েও শেষ করতে পারবেন না।

রাজা মহাশয় দ্রুত বলল- আরে বলো বলো, তাড়াতাড়ি বলো। কি সেই বুদ্ধি?

শেয়াল কান ঝেড়ে বলল, ওই যে বনের পাশে সবুজ ঘাসওয়ালা একটি মাঠ দেখছেন; ওই মাঠে বাঁধা আছে একটি মোটাতাজা ইয়া বড় গরু। আপনি বরং একটু কষ্ট করে ওই মাঠে গিয়ে গরুটাকেই খেয়ে নিন। তাতে এক শিকারে অনেক দিন চলে যাবে।

শেয়ালের পরামর্শে রাজা মশাই দারুণ খুশি। অহঙ্কারী রাজা ভীষণ লোভী। তার লোভ লকলকিয়ে উঠল। দেরি না করে ছুটল মাঠের দিকে। গিয়ে দেখল, সত্যিই তো, একটি গরু বাঁধা আছে মাঠে। গরুটি বেশ বড়সড়ও। আহা। খুব মজা করে খাওয়া যাবে বৈকি।

রাজা মশাইয়ের লোভ আরো চাগিয়ে উঠল। বলল, এই গরু আমি তোমাকে খাবো। আজ থেকে তিন দিন খাইনি। তোমাকে খেয়ে ক্ষুধা মেটাব।

গরুটা ছিল বেশ বুদ্ধিমান। সে দেখল, এ যে ভারি বিপদ! এ অহঙ্কারী রাজা থেকে বাঁচতে হলে কৌশল করতে হবে। নইলে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

গরুটি বলল, মহামান্য রাজা আমাকে আপনি খাবেন, এ তো আমার বড় আনন্দ! কিন্তু আমার গায়ে যা দেখছেন এর সবই হাড্ডি। কারণ আমার মালিক আমাকে বেঁধে রেখে গেছে। আমি ঘাস খেতে পারিনি। আর ঘাস না খেলে মাংস কী করে হবে? আপনি বরং একটি কাজ করুন। আমার রশিটি আপনি দাঁত দিয়ে কেটে দিন। আমি ঘাস খেয়ে মোটাতাজা হই। এই ফাঁকে আপনি বনের ছায়ায় গিয়ে বসুন। আমার ঘাস খাওয়া শেষ হলে এসে আমাকে খেয়ে নেবেন।

শুনে অহঙ্কারী রাজা বেজায় খুশি। তাড়াতাড়ি গরুর রশিটি কেটে দিলো। ছাড়া পেয়ে গরু ঘাস খেতে শুরু করল। প্রখর রোদ। রাজা মশাই অনেক দিন বনের ছায়ায় এক জায়গায় থাকার কারণে এতটুকু গরমও সহ্য করতে পারছিল না। তাই মাঠের ধারে বনের ছায়ায় গিয়ে বসে রইল।

এদিকে গরুটি দারুণ একটি পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো। ঘাস খেতে খেতে পরিকল্পনাটি গুছিয়ে নিলো সে। কোনোভাবেই পরিকল্পনায় ফেল করা যাবে না। একে তো অহঙ্কারী রাজা। আবার চরম বদমেজাজি; নির্মমও। তাই তাকে পরাস্ত করার কৌশলটি সেরকম হতে হবে।

মাঠের পাশেই একটি মজা নদী। নদীটি কাদা পানি আর বালিতে ভর্তি। ঘাস খেতে খেতে সেই নদীর ধারে এসে পড়ল গরুটি। বনের দিকে তাকিয়ে দেখল, ছুটে আসছে স্বঘোষিত রাজামশাই। রাজাকে আসতে দেখে কেঁপে উঠল বুক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গরু অতি দ্রুত নেমে পড়ল সেই মজা নদীতে। নদীর কাদা এবং বালির জন্য সামনে এগুনো বড় মুশকিল। তবুও ঘাস খেয়ে তরতাজা হওয়ায় বেশ শক্তি হলো গরুর গায়ে। কাদা বালির ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে নদীর প্রায় মধ্যখানে এসে পড়ল।

ততক্ষণে বাঘ এসে দাঁড়াল নদীর কিনারে। মুহূর্তে বুঝে গেল, গরু ধোঁকা দিয়েছে তাকে। ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল রাজা মশাই। হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ওরে গরু, শাস্তি তোকে পেতেই হবে। আমার সাথে কারসাজি করে পার পাওয়া যাবে না। আমার সাথে চালাকি! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।

এই বলে নদীতে লাফিয়ে পড়ল রাজামশাই। অহঙ্কারী লোভী রাজা বুঝতেই পারেনি নদীর বালিয়াড়ি ও কাদার ভয়াবহতার কথা। যেই না দিলো লাফ অমনি প্রায় পুরোটাই কাদাবালির ভেতর ডুবে গেল সে। কোনো রকমে কিছুটা নাক মুখ তুলে শ্বাস নিচ্ছিল। এভাবেই সামনে এগোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু তিন দিন না খেয়ে দুর্বল শরীরে এগুতে সক্ষম হলো না। ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করল, তাও পারল না।

গরুকে লক্ষ করে বলল, তোকে আমি যেভাবেই হোক, শেষ করে ফেলব!

গরু হেসে বলল, সেটি আর পারবে না তুমি। একটু পরই আমার মালিক আসবে। আমাকে উদ্ধার করবে এখান থেকে। আর তোমাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারবে!

শুনে মহারাজার দম আটকে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু তার কিছুই যে করার সাধ্য আর নেই!

বন্ধুরা, গল্পটি রূপকথার হলেও, এর বাস্তবতা মানুষের সমাজে বিদ্যমান। গোটা পৃথিবীতেই মানুষ মানুষের কর্তা হয়ে বসে। মানুষ মানুষের মালিক বনে যায়। মানুষ মানুষের ওপর আধিপত্যের খড়্গ তোলে। তাই বলা হয়, মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। মানুষই মানুষের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর! নিজেকে নিয়মের ঊর্ধ্বে ভাবার প্রবণতা থেকেই মানুষ অহঙ্কারী হয়ে ওঠে। নিজেকে সবার সেরা ভাবনা থেকে দাম্ভিকতায় পেয়ে বসে মানুষকে। তখনই একজন শাসক রাষ্ট্রকে নিজের বা পারিবারিক সম্পদ মনে করে। এমন শাসকদের ভেতর লোভ লালসা বেড়ে ওঠে খুব। লাগামহীন লোভের কারণে তারা চিরদিন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখতে থাকে।

তখন বন্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক পথ। জোর জবরদস্তি করে নিজেকে চাপিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকে না। কিন্তু এভাবে কতদিন! জগতের সব কিছুর একটি শেষ আছে। শেষ আছে সব শুরুর। শেষ থেকে হয় আবার শুরু। অর্থাৎ পৃথিবীর যেকোনো কিছুর যেখানে শুরু আছে, সেখানে শেষও আছে। আবার শেষ হলেই সেখান থেকে নতুন শুরুর গল্প।

বন্ধুরা, এবারে রয়েছেন একটি আবৃত্তি। 'বিজয় এলো পাখির গানে' শিরোনামের কবিতাটি লিখেছেন মঈন মুরসালিন। আর আবৃত্তি করেছে ঢাকার সারেগামা একাডেমির সদস্য মাফরুহা বিনতে শাকুর।  

মাফরুহার চমৎকার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। বন্ধুরা, এবার তোমাদের জন্য রয়েছেন বিজয় দিবসের গান। লিখেছেন নাইম আল ইসলাম মাহিন, সুর করেছেন এম. ও. তারেক আর গেয়েছে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি আসরের শিশু শিল্পী অরিত্রা সাহা, আহনাফ আদিল শাফী, সালভি নাওয়ার জারিফ। 

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে। 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২১

ট্যাগ