ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩ ১৭:৫১ Asia/Dhaka
  • সূরা আত-তাগাবুন: ৭-১২ (পর্ব-২)

আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা তাগ্বাবুনের ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ৭ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:  

 

“যারা কাফির হয়েছে তারা ধারণা করে যে, তারা কখনোই পুনরুত্থিত হবে না। আপনি বলুন, হ্যাঁ, আমার প্রতিপালকের কসম! তোমরা সবাই অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদেরকে সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে। আর এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ।”

“অতএব তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও যে নূর [অর্থাৎ কুরআন] আমি নাযিল করেছি তাতে ঈমান আন। আর [জেনে রেখো] তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ্ সবিশেষ অবহিত।”

গত আসরে আমরা কাফিরদের পক্ষ থেকে নবী-রাসূলগণকে অস্বীকার করা সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। এরপর আজকের এই দুই আয়াতে কাফিরদের পক্ষ থেকে কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করার কথা বলা হয়েছে।  আল্লাহ বলছেন: তারা তাদের বক্র চিন্তা থেকে এই ধারনা করে যে, মৃত্যুর পরে কিয়ামত সংঘটিত হবে না। এ কারণে তারা আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজেদের কৃতকর্মের জবাব দেওয়ার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে না। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে, তোমরা নিশ্চিত থেকো, তোমাদেরকে কিয়ামত দিবসে হাজির হতে হবে এবং একইসঙ্গে তোমরা পৃথিবীতে যা কিছু করেছো সে ব্যাপারে আল্লাহর আদালতে তোমাদের বিচার হবে। আর তোমাদের মন্দ ও ভালো কাজের ভিত্তিতে তোমাদেরকে শাস্তি বা প্রতিদান দেওয়া হবে।

পরের আয়াতে এই বক্র চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পক্ষ থেকে নাজিল করা পবিত্র কুরআনের প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে: মহান আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং তার সৃষ্টিসমূহের কৃতকর্মের ওপর আল্লাহ তায়ালার পরিপূর্ণ দৃষ্টি রয়েছে। কারণ, আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছু নেই এবং তিনি তোমাদের প্রতিটি কাজ সম্পর্কে সম্যক অবহিত।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:

১- পরকালে অস্বীকারকারীরা কোনো ধরনের যুক্তি ও দলিল ছাড়া শুধুমাত্র ধারনার ভিত্তিতে কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করে।

২- পৃথিবী হচ্ছে আমল করার এবং আখেরাত হচ্ছে হিসাব দেওয়ার স্থান। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের সকল কর্ম রেকর্ড করে রাখা হয় এবং কিয়ামত দিবসে তার আমলনামার ভিত্তিতে তাকে প্রতিদান বা শাস্তি দেওয়া হবে।

৩- যে আল্লাহ এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তার জন্য কিয়ামত দিবসে মৃত মানুষদের জীবিত করা এবং তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা একটি অতি সহজ কাজ।

৪- দাম্ভিকতা ও গোঁয়ার্তুমির কারণে কুফর ও শিরক করলে মানুষ জুলুমাত বা অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর কুরআনের আয়াত মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করে।

(তাওয়াশিহ)

এবারে সূরা তাগ্বাবুনের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“[স্মরণ কর] যেদিন তিনি তোমাদেরকে সমবেত করবেন [কিয়ামতের] সমাবেশ দিবসে।  সেদিন হবে অনুতাপ ও লোকসানের দিন। আর যে আল্লাহর উপর ঈমান রাখে এবং সৎকাজ করে [আল্লাহ] তার পাপসমূহ ঢেকে দেবেন এবং তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। এটাই মহাসাফল্য।”

“আর যারা কুফরী করে এবং আমার আয়াত বা নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। কত মন্দ সে ফিরে যাওয়ার স্থান!”

এই দুই আয়াতে কিয়ামত দিবসের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। আর সেই বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে কিয়ামত দিবসে মানুষের অনুতাপ ও ক্ষতি।  সেদিন আল্লাহর নেক বান্দারা এই বলে অনুতাপ করবে যে, আমি কেন আরো নেক আমল বা সৎকাজ করিনি। অন্যদিকে অপরাধীরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করবে।

কিয়ামতের ওই কঠিন দিনে আল্লাহ তায়ালার দয়া ও ক্ষমা লাভের উপায় হিসেবে এখানে কুফর, শিরক ও নিফাক থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে: এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি যাদের ঈমান আছে এবং যারা নেক আমল করেছে মহান আল্লাহ তাদের গোনাহসমূহ উপেক্ষা করবেন, তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

কিন্তু যারা কুফরি করবে ও আল্লাহকে অস্বীকার করবে অর্থাৎ যারা সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও তা মেনে নিতে এবং সে অনুযায়ী আমল করতে অস্বীকার করবে তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় তাদের থাকবে না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আগেই কিয়ামত দিবসের অনুতাপ থেকে বাঁচতে চাইলে আমাদেরকে নিজেদের ঈমান মজবুত করে যথাসম্ভব নেক আমল বা সৎকাজ করে যেতে হবে। তাহলে কিয়ামত দিবসে আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে পারব।

২- আল্লাহ তায়ালা মানুষের নেক আমলের ভিত্তিতে তাকে প্রতিদান দেবেন এবং সেইসঙ্গে ওই নেক আমলের ভিত্তিতে তার গোনাসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।

৩- জান্নাতে প্রবেশ করার আগে মানুষকে সব রকম গোনাহ ও কলুষতা থেকে মুক্ত করা হবে। হয় তাকে আল্লাহ সরাসরি ক্ষমা করে দিয়ে তাকে গোনাহমুক্ত করবেন অথবা তাকে কিছুদিন জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করে কলুষমুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে হবে।

৪- সকল মানুষ সুখী হতে এবং সফলতা অর্জন করতে চায়। আর এই সফলতার মধ্যে মহাসাফল্য হচ্ছে পার্থিব জগতে নেক আমল করে পরকালীন অনন্ত জীবনে জান্নাত লাভ করা।

এবারে সূরা তাগ্বাবুনের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই কারো ওপর আপতিত হয় না এবং কেউ আল্লাহর উপর ঈমান রাখলে তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।”

“আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের অনুসরণ কর; অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে [জেনে রেখো] আমার রাসূলের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া, [অন্য কিছু নয়]।”

পার্থিব জীবনে প্রতিটি মানুষকেই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সমস্যা ও সংকটের মধ্যে পড়তে হয়। এ সময় বেশিরভাগ মানুষ আশাহত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার প্রতি যাদের ঈমান আছে তারা জানে যে, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কোনো বিপদ আসে না।  এ কারণে তারা বিপদ ও সংকটে সবর করে বা ধৈর্য ধারণ করে এবং একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, এই ধৈর্যের প্রতিদান আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া যাবে।

মুমিন ব্যক্তিরা বিপদে পড়ার কারণে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থেকে বিরত থাকে না। কিন্তু সবাই এরকম নয়। বহু মানুষ আরাম আয়েশে থাকা অবস্থায় আল্লাহর ইবাদত করলেও বিপদে পড়লে সেজন্য আল্লাহকে দায়ী করে তাঁর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অবশ্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কখনও চাননি মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের আনুগত্য করুক। বরং নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব ছিল মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরা। যাতে মানুষ সত্য উপলব্ধি করে স্বেচ্ছায় নেক আমল করতে পারে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- বিপদ আপদ ও দুর্বিপাকে মানুষকে যে বিষয়টি স্থির ও অবিচল রাখতে পারে তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান। ঈমানদার ব্যক্তি জানেন যে, আল্লাহ তাঁর অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত কাজেই বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে তিনিই তাকে মুক্তি দেবেন।

২- নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু মানুষকে বাধ্য করা তাদের দায়িত্ব নয়। কারণ, মানুষকে আল্লাহ স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই আল্লাহর আনুগত্য করা কিংবা আল্লাহর আদেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা রয়েছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৫

ট্যাগ