ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৪ ১৯:৫৮ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি মানুষ পূর্ণতার সন্ধানী হওয়ায়, ন্যায়বিচারকামী হওয়ায় বা জুলুম, বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরোধী হওয়ায় এমন একজন সংস্কারক বা ত্রাণকর্তার আগমনের প্রত্যাশী যিনি সারা বিশ্বে শান্তি, ন্যায়বিচার বা সাম্য প্রতিষ্ঠা করবেন এবং দুর করবেন সব জুলুম, নির্যাতন আর দারিদ্র।

তিনি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করবেন ঐক্যবদ্ধ ও সর্বোচ্চ জন-কল্যাণমূলক সরকার। শেষ ত্রাণকর্তার আগমনের প্রত্যাশার আরেকটি বড় কারণ হল বিশ্বের নানা ধর্মের বাণীতেও সংস্কারকের বা ত্রাণকর্তার আগমনের আশাবাদ বা ভবিষ্যদ্বাণী দেখা যায়। ঐশী ধর্মগুলো ছাড়াও সব ধর্মেই শেষ ত্রাণকর্তার আগমনের ধারণা দেখা যায়। খোদায়ী সব ধর্মের দৃষ্টিতেই মানুষের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং বিশ্ব দিনকে দিন অত্যাচারিতের পক্ষে এগিয়ে আসছে। কারণ, ন্যায় বিচার ও সাম্য খোদায়ী বিধান হিসেবে স্থায়িত্ব পাবার যোগ্য এবং নিপীড়ন ও বৈষম্য ধ্বংসশীল। একজন সংস্কারক এসে বিশ্বকে জুলুম ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করবেন এমন বিশ্বাস সব ধর্মেই রয়েছে। আর মানবজাতির ভবিষ্যৎ মুক্তির ব্যাপারে এমন আশা থাকাতেই মানুষ উন্নততর ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করতে আগ্রহী। 

সব ধর্মীয় গ্রন্থেই ভিন্ন নাম ও বৈশিষ্ট্যসহ সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সুসংবাদ দেখা যায় ।  বর্তমান বিশ্বের তিন প্রধান ঐশী ধর্ম  তথা ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্মে শেষ ত্রাণকর্তার আগমন সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। এসব বাণীতে বেশ কিছু অমিল থাকলেও বেশ কিছু মিলও রয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের বইগুলোতে শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত নানা ধরনের সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী কিছু বর্ণনা রয়েছে।

খৃষ্ট ধর্মের মথির লিখিত বাইবেলের ২৪ তম অধ্যায়ে শেষ যামানায় প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তার আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে: আকাশে বিদ্যুতের চমক যেমন পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়ে পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, মানুষের সন্তানের তথা শেষ ত্রাণকর্তার বিষয়টিও সেরূপ হবে। 'মানুষের সন্তান' আকাশের মেঘে চড়ে বিপুল শক্তি নিয়ে আসছেন। ..... কিন্তু  (তাঁর আবির্ভাবের )সেই দিন ও ঘণ্টা সম্পর্কে কেউই জানে না এবং এমনকি আকাশের ফেরেশতারাও তা জানেন না। .... তাই সজাগ থাক, কারণ, তোমরা জান না যে ঠিক কোন সময় তোমাদের নেতা আসবেন। 

লুক লিখিত বাইবেলেও বলা হয়েছে, তোমাদের কোমরগুলো বেঁধে রাখ ও বাতিগুলো জ্বালিয়ে রাখ। তোমরা তাদের মত হও যারা নিজ নেতার আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করছে, যাতে যখনই তিনি আসেন এবং দরজায় করাঘাত করেন তখনই যেন তোমরা তাঁর জন্যে দরজা খুলে দিতে পার। 

খৃষ্টানদের মতে প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা হলেন হযরত ঈসা (আঃ), যিনি পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবেন এবং বিশ্বকে অসঙ্গতি বা সংকটগুলো থেকে মুক্ত করে বিশ্ববাসীর জন্যে নিরঙ্কুশ শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করবেন।  খৃষ্টানরা মনে করে হযরত ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হবার ও সমাধিস্থ হবার তিন দিন পর কবর থেকে উঠে আকাশে চলে যান। ভবিষ্যতে তিনি আকাশ থেকে আবার পৃথিবীতে নামবেন। বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ের ১৩ নম্বর লাইনে বলা হয়েছে, “ তাই ঠিক সেভাবে প্রস্তুত ও সতর্ক থাক যেভাবে মানুষ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত থাকে। হযরত ঈসা মাসিহর পুনরাগমনের জন্যে অপেক্ষা কর। কারণ, সেদিন তোমরা মহা-অনুগ্রহ ও দয়া পাবে।” 

খৃষ্টানদের ধর্মীয় বর্ণনামতে, হযরত ঈসা (আঃ) নিজেই তাঁর পুনঃআবির্ভাবের জন্যে প্রার্থনা করতে বলেছেন। এসব বর্ণনায় তিনি দুই শ্রেণীর মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন : “ এক শ্রেণীর মানুষ হযরত ঈসা(আঃ)’র অনুপস্থিতির অপব্যবহার করেছে এবং তারা অন্যদের জীবন ও সম্পদের হানি করেছে। আর অন্য একদল  হযরত ঈসার পুনরাগমনের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করছে।

ইরানে ইমাম মাহদির জন্মদিন উপলক্ষে কোমের জামকারান মসজিদে  রাতের আলোক-সজ্জা ও মহাসমাবেশ

 লুকের লিখিত বাইবেলের ১২ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে,  সেই দাসরা কতই না সৌভাগ্যবান যাদেরকে নিজের নেতা প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পাবেন। কিন্তু যে দাস বা সেবক তার নেতার ইচ্ছার কথা জানা সত্ত্বেও সে ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করবে না তাকে চাবুকের অনেক আঘাত পেতে হবে ... যাকেই ব্যাপক মাত্রায় দান করা হবে, তার কাছ থেকে প্রত্যাশাও বেশী করা হবে এবং যার কাছে বেশী আমানত রাখা হবে তাকে বেশী জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” অবশ্য হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বা বক্তব্য ভিন্ন ধরনের। পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনামতে,  ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হন নি এবং তিনি জীবিত আছেন। হযরত ঈসা (আঃ) প্রতিশ্রুত দিনে ফিরে আসবেন বলেও ইসলামী বর্ণনা রয়েছে। এইসব বর্ণনা অনুযায়ী পৃথিবীর ইতিহাসের শেষ যুগে বা আখেরি জামানায় মানুষের ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদী (আঃ)’র আবির্ভাবের সময় ঈসা (আঃ)ও পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। তিনি ইমাম মাহদী (আঃ)’র পেছনে নামাজ পড়বেন এবং তাঁরা দুজনে সারা বিশ্বে ন্যায় বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাবেন। 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে খৃষ্ট ধর্ম হযরত ঈসা (আঃ)’র প্রকৃত শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে। পাশ্চাত্যে ও বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ধর্মীয়-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব রয়েছে তা ইহুদিবাদী-খ্রিস্টবাদ নামে পরিচিত। এই মতবাদ খৃষ্ট ধর্মের অন্যতম শাখা। উগ্র ইহুদি ও খৃষ্টানদের চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটেছে এ মতবাদে। মার্কিন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই এই মতবাদের প্রধান ধারক ও বাহক। ইহুদিবাদী খৃষ্টানদের মতে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পটভূমি তৈরির জন্যে আরমাগেড্ডন নামের বিশাল এক যুদ্ধের প্রয়োজন এবং এজন্যে অসংখ্য অপরাধযজ্ঞ সংঘটিত করাও বৈধ।

মথির লিখিত ইঞ্জিল বা বাইবেলে মিথ্যা মাসিহ বা ভুয়া ত্রাণকর্তা ও ভুয়া নবীর  আবির্ভাবের দাবি সম্পর্কেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এবং তাদের অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কাজ দেখে নির্বাচিত সৎ ব্যক্তিরাও পথভ্রষ্ট হবেন বলে সাবধান করা হয়েছে। 

ইসা মাসিহ ফিরে আসার আগে শেষ যামানায় অনেক যুদ্ধ হবে এবং সংক্রামক রোগগুলো অনেক বেড়ে যাবে, এ ছাড়াও দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, জুলুম ও  অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাবে বলে বাইবেলে বর্ণনা রয়েছে। মাসিহ'র পুনরাবির্ভাবের আগে জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাসে জাতিগুলোর দলন ঘটবে বলেও উল্লেখ রয়েছে বাইবেলে। বলা হয়েছে, অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখে মানুষেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হবে। বাইবেলের বক্তব্য অনুযায়ী সে সময় বড় বড় জালিম সরকার হামলা চালাবে এবং দাজ্জালের নেতৃত্বে দুই অদ্ভুত জন্তু বের হবে। দুর্বৃত্ত বা শয়তানি বাহিনীর সঙ্গে বিশ্বাসী বাহিনীর বড় রকমের লড়াই হবে এবং তাতে বিশ্বাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন হযরত ইসা মাসিহ (আ) ও একজন খোদায়ি ফেরেশতা। ফিলিস্তিনের আরমাগেড্ডন বা হারমাজিদ্দুন নামক স্থানে এই মহাযুদ্ধ হবে। আর এতে জালিম বাহিনীর সবাই নিহত হবে। দাজ্জালকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে এবং হযরত ইসার এক হাজার বছরের শাসন শুরু হবে। বাইবেলে এসেছে, এ সময় শয়তানকে শেকলে বেঁধে বন্দি করা হবে এবং মানুষের জন্য কল্যাণ, সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য, সুখ, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার কায়েম হবে। এই নতুন রাষ্ট্র কেবল তাদেরকেই দেয়া হবে যারা বিশ্বাসী এবং যাদেরকে বাছাই করে নেবেন খোদ মাসিহ নিজে।  

মুসলমানরাও বিশ্বাস করেন হযরত ইমাম মাহদি (আ) শেষ ত্রাণকর্তা হিসেবে আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন এবং সমস্ত কুসংস্কার ও বিকৃতি দূর করবেন। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ