মে ০৯, ২০২৪ ২০:৫৭ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা শুনেছি বৌদ্ধ ধর্মেও শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা রয়েছে। এ ধর্মের অনুসারীদের মতে এমন একজন বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আসবেন যিনি বৌদ্ধের শিক্ষাগুলোর প্রচলন ঘটাবেন।

তিনি জনগণকে নির্যাতন ও কষ্ট থেকে মুক্ত করবেন এবং ক্রমেই পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেবেন। বৌদ্ধ ধর্মের নানা ধারায় বিশেষ করে মহাযানা ধারায় শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও ভাগ্য-নির্ধারণী বিষয়। বৌদ্ধ ধর্মের দৃষ্টিতে বিশ্ব নানা যুগের অধঃপতনের শিকার হয়েছে। যুগে যুগে মানুষের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে পাপাচার ও নৈরাজ্য। মানুষের মধ্যে যখন পাপাচার ও নৈতিক অধঃপতন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখনই একজন বৌদ্ধ ত্রাণকর্তা হয়েছেন আবির্ভূত। তিনি মানুষকে দেখিয়েছেন সুপথ এবং ফিরিয়ে এনেছেন প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি। বৌদ্ধদের পঞ্চম ও শেষ প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা হলেন মৈত্রিয়া। তিনি প্রথমে ছিলেন একজন রাজা। পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে ঐশী মাত্রা লাভ করেন এবং ঊর্ধ্ব জগতে চলে যান। তিনি আবারও মানুষ হিসেবে ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি ফিরে এসে মানুষকে মুক্তি সর্বোচ্চ পর্যায় তথা নির্বাণের স্তরে পৌঁছাবেন।

বৌদ্ধদের একদলের মতে বুদ্ধের যুগের পাঁচ হাজার বছর পর তার শিক্ষাগুলো মলিন বা বিলুপ্ত-প্রায় হয়ে যাবে। এ সময় মানুষের আয়ু মাত্র দশ বছরে নেমে আসবে। তবে এই শোচনীয় অবস্থাও টিকে থাকবে না খুব দীর্ঘকাল, মানুষ আবারও সত্য ও সততার দিকে ফিরে আসবে এবং মানুষের আয়ু বেড়ে হবে ৮০ হাজার বছর।  অবশেষে একজন ন্যায়পরায়ণ রাজা ক্ষমতায় এসে বৌদ্ধ ধর্মকে ছড়িয়ে দিবেন।  এ সময় আকাশ থেকে নেমে আসবেন মৈত্রিয়া। তিনি ছড়িয়ে দিবেন বুদ্ধের শিক্ষা যথাসম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায়।  মানুষের মাঝে আবারও ফিরে আসবে নৈতিকতা এবং তারা হবে নির্বাণ-প্রাপ্ত বা মুক্তিপ্রাপ্ত।  কিন্তু বৌদ্ধদের অন্য একদলের মতে মৈত্রিয়া তখনই আসবেন যখন বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে জুলুম ও অনাচার। বিশ্বজগত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তিনি গড়ে তুলবেন এক নতুন জগত বা পরিবর্তিত অবস্থা যা হবে কল্যাণ, মৈত্রী ও সম্পদে পরিপূর্ণ। 

বৌদ্ধদের উল্লেখিত ত্রাণকর্তা জনগণকে কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব হতে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাবেন। যারা এই আহ্বান গ্রহণ করবে তারা মুক্তি পাবে। তবে বেশিরভাগ মানুষই এই আহ্বান মেনে নেবে না। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। মৈত্রিয়ার গড়ে তোলা সমাজে মানুষ হবে অহংকার ও কু-প্রবৃত্তিগুলোর দাসত্ব হতে মুক্ত। বরং তারা জ্ঞান, প্রজ্ঞা, প্রাচুর্য এবং নবী-রাসুলদের অলৌকিকতাগুলোর অধিকারী হবে। ফলে গোটা বিশ্বে বিরাজ করবে গভীর শান্তি। সেই সময় কেউ অপরাধ ও পাপ করবে না। এভাবে বৌদ্ধ ধর্মেও শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সুসংবাদ দেখা যায়।

চীনাদের কনফুসিয় ও তাও ধর্মকে একত্রে সুংজিয়াও বলা হয়। শেষ যুগ সম্পর্কে এ দুই ধারার বিশ্বাসে ব্যাপক মিল রয়েছে। তাদের ত্রাণকর্তাও এমন সময় আসবেন যখন বিশ্বে ব্যাপক জুলুম ও অনাচার ছড়িয়ে পড়বে এবং ধর্ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধান হবে ব্যাপক মাত্রায় উপেক্ষিত। তাদের ত্রাণকর্তা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি নন বরং তাঁর রয়েছে আধ্যাত্মিক ও ঐশী বা আসমানি মাত্রার ব্যাপকতা বা গভীরতা। তিনি মানুষদের হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তবে পৃথিবীতে তাঁর আগমন এবং বিশ্বজুড়ে তাঁর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে অবশ্যই প্রভু বা স্রস্টার অনুমতি পেতে হবে।

 ইউরোপীয় জাতিগুলো ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ও রেড-ইন্ডিয়ান জাতির মধ্যেও শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা রয়েছে

চীনাদের প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তার আগমনের উদ্দেশ্য হল সোনালী যুগের সূচনা করা। চীনাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মানবজাতির মাঝে ঐকতান এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী আর জীবের মধ্যে সমন্বয়ের ফলে সব নৈতিক গুণের বিকাশ ঘটার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়বে শান্তি। আর সোনালী যুগে এই ঐকতান ও সমন্বয় সর্বোচ্চ বা পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছাবে। চীনাদের প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তার যুগে পছন্দনীয় নৈতিকগুলো বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সে যুগে মানবীয় কুপ্রবৃত্তিগুলো হবে দমিত এবং আত্মত্যাগ, সহমর্মিতা, মানবপ্রেম, দয়ার বিস্তার ঘটবে ও মানুষের মধ্যে প্রচলিত হবে যোগ্যতা-ভিত্তিক নেতৃত্বের। ফলে সমাজে ঘটবে শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের কর্তৃত্ব। চীনাদের প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তার যুগে জনগণ হবে একই ধর্মীয় বিধান ও ধর্মের অনুসারী। মানুষের মধ্যে সম্পদের বণ্টন হবে ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে, বংশীয় ও গোত্রীয় পরিচয়ের কোনো সুবিধা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে থাকবে না। সুংজিয়াও ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকে সোনালী যুগই ইতিহাসের সমাপ্তি নয়, মানুষের অধঃপতনের পর ত্রাণকর্তাও আবারও ফিরে আসবেন বা বার বার ফিরে আসবেন। ফলে শেষ জামানা বা কিয়ামতের পূর্বাবস্থা কয়েক বারই দেখা দিতে পারে।

প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কে আমরা যেসব ধর্মের কিছু ধারণা তুলে ধরলাম সেসবের বাইরে মধ্য আমেরিকায় স্প্যানিশ ও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাতে ব্যাপক গণহত্যার শিকার রেড-ইন্ডিয়ান জাতির মধ্যেও শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা রয়েছে। রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে যারা বেঁচে গেছেন তাদের মতে এই জাতির কোনো এক ব্যক্তি আসমানি সত্ত্বায় পরিণত হয়েছেন এবং কোনো অজ্ঞাত কারণে তিনি ধ্বংস বা অদৃশ্য হয়েছেন, তবে তিনি ভবিষ্যতে ফিরে আসবেন এবং জনগণকে মুক্ত করবেন।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মনে করে পৃথিবী তখনই নিঃশেষ হবে যখন ঐশী বা আসমানি ব্যক্তিদের গড়ে তোলা আধ্যাত্মিক ব্যবস্থাপনা শেষ হয়ে যাবে। স্ল্যাভ জাতিগুলোও মনে করে পূর্বাঞ্চল থেকে এক মহাপুরুষ বিপ্লব ঘটাবেন, তিনি সব স্ল্যাভ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। ব্রিটেনের কোনো কোনো দ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যেও একই ধরনের বিশ্বাস দেখা যায়। তারা মনে করেন আর্থার নামক এক ব্যক্তি কোনো এক দ্বীপে বসবাস করেন। তাঁর আবির্ভাব ঘটলে তিনি অ্যাংলো সেক্সন জাতিগুলোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন বিশ্বের ওপর এবং তখন বিশ্বের সব সৌভাগ্যের অধিকারী হবে তারা।

স্ক্যান্ডেনিভিয়ান জাতিগুলোও মনে করে যে পৃথিবী যখন নানা সংকট ও যুদ্ধে জর্জরিত হবে এবং মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আসমানি ক্ষমতার অধিকারী ওডিন নামক এক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটবে এবং তিনি সব কিছুর ওপর কর্তৃত্ব করবেন। আফ্রিকান জাতিগুলোর মধ্যেও ত্রাণকর্তার ধারণা বেশ জোরালো। অতীতের জাতিগুলোর মধ্যেও যেমন, রোমান ও মিশরীয়দের মধ্যে সংস্কারক বা ত্রাণকর্তার আগমনে ধারণা ছিল।  অতীতের অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদও শেষ যামানায় একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটাকে অনিবার্য বলে মনে করতেন। তাদের কেউ কেউ নিজ নিজ পছন্দের আদর্শ বিশ্ব-রাষ্ট্রের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাই এটা স্পষ্ট যে কোনো এক যুগে বহু মহতী গুণের অধিকারী এমন একজন মহাসংস্কারক আসবেন যিনি মানুষকে মুক্তি দিবেন ও উন্নত বিশ্ব গড়বেন। #

পার্সটুডে/০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ