ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৪ ১০:৪৫ Asia/Dhaka

মানবজাতিকে সব দুঃখ-কষ্ট ও বৈষম্য, দারিদ্র আর অন্যায়-অবিচার এবং অনাচার থেকে মুক্ত করতে শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা বিভিন্ন মতবাদ বা মতাদর্শ ছাড়াও সব ধর্মেও দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে আমরা গত কয়েক পর্বে খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্মে শেষ-ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত কয়েকটি ধারণা তুলে ধরেছি।

আমরা দেখেছি এসব ধারণার মধ্যে কিছু মৌলিক মিল রয়েছে, আবার অনেক অমিলও রয়েছে। মিলের দিকগুলো হল শেষ ত্রাণকর্তা যখন আসবেন তার আগমনের আগে পৃথিবীতে ব্যাপক অশান্তি, অনাচার, দুর্নীতি ও যুদ্ধ বিরাজ করবে। কিন্তু শেষ ত্রাণকর্তা এসে এসবই দূর করবেন এবং তাঁর অনুরাগী ও অনুসারী বাহিনীর হাতে পরাজিত হবে দুর্বৃত্ত বা মন্দ লোকদের বাহিনী। শেষ ত্রাণকর্তার অনুসারী ও সেনা সংখ্যা হবে বিপুল। শেষ ত্রাণকর্তার শাসনামলে ব্যাপক সমৃদ্ধি, কল্যাণের প্রাচুর্য, আধ্যাত্মিকতা ও শান্তি আর নিরাপত্তা বিরাজ করবে। ইসলাম ধর্মে হযরত ইমাম মাহদি-আ. বা শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাব সংক্রান্ত ধারণাগুলোর সঙ্গেও এইসব ধারণার মিল রয়েছে। আর যেসব অমিল দেখা যায় সেসবের কারণ সম্ভবত ইসলাম-পূর্ব যুগের ধর্মগুগ্রন্থগুলোর বিকৃতি বা এসব গ্রন্থের মধ্যে নিজ ধর্মের বাইরের মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ।   

ইহুদি ধর্মগ্রন্থে শেষ ত্রাণকর্তার বিজয়ের বিষয়ে সুনিশ্চিত আশাবাদ ব্যক্ত করে  বলা হয়েছে, “দুষ্ট লোকদের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ো না, কারণ, দুষ্ট লোকরা শিগগিরই ঘাসের মত কর্তিত হবে। স্রষ্টার ওপর ভরসা কর ও সৎকর্ম কর। স্রষ্টার জন্যে অপেক্ষমাণরাই এই পৃথিবীর শাসক হবে এবং তারা প্রাচুর্য ও সুস্থতার অধিকারী হবে। দুর্বৃত্তরা সত্যের অনুসারী, দরিদ্র ও নিঃস্বদের হত্যার জন্যে তলোয়ার উন্মুক্ত করবে ও তীর নিক্ষেপের উদ্যোগ নিবে। কিন্তু তাদের তলোয়ার নিজের ওপরই আঘাত হানবে এবং তাদের ধনুকগুলো ভেঙ্গে যাবে।” ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের কোনো কোনো অধ্যায়ে সংস্কারকদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা এসেছে। আদর্শবাদী ইহুদিদের ধারণায়ও দেখা যায় সমস্ত মানুষ এক সময় খোদাপ্রেমিক হয়ে যাবে এবং বিশ্বে মূর্তি-পূজা ও অধর্মের কোনো অস্তিত্বও থাকবে না। পবিত্র কুরআনের সূরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বর আয়াতেও এ বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। এ আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী মহান আল্লাহ তাওরাতেও এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে একদিন সৎকর্মশীলরা বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব করবে।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, আমরা তাওরাতের পর যাবুরে লিখেছিলাম যে আমার সৎকর্মশীল দাসরা পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে।
হযরত দানিয়েল নবী শীর্ষক গ্রন্থের বারোতম অধ্যায়ে পৃথিবীতে একদল বিশ্বাসীর ও দুর্বৃত্তের পুনরাগমনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পর তারা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবে এবং তারা তাদের সৎ ও মন্দ কাজের প্রতিফল পাবে।

ইহুদিদের প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তার শাসনামলে বস্তুগত সমৃদ্ধি হবে অকল্পনীয় মাত্রায়। তাওরাতে এসেছে, নহর বা খালের এই পাড়ে ও ওই পাড় জুড়ে থাকবে সারি সারি খাদ্যের গাছ। এসব গাছের পাতা কখনও বিবর্ণ হবে না এবং সেসবের ফল প্রদান কখনও বন্ধ হবে না। প্রতি মাসে সেসবে নতুন নতুন ফল আসবে। কারণ এসব গাছ পানি পাবে পবিত্র স্থানের। এসব গাছের ফল হবে খাদ্য ও পাতাগুলো হবে রোগের ওষুধ।

ইরানের কোম শহরের বিখ্যাত জামকারান মসজিদ। স্বপ্নে দেখে ইমাম মাহদির-আ. নির্দেশে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে

বনি ইসরাইল নিজেকে আল্লাহর মনোনীত জাতি বলে মনে করতো। তারা এমন এক যুগের জন্যে অপেক্ষা করেছিল যখন খোদায়ী ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে এবং তাদের শত্রু নির্মূল হবে ও সেইসাথে বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার ও কল্যাণ ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হল হযরত দাউদ ও সুলায়মান(আঃ)’র রাজত্বের পর ইহুদি জাতি নিজেই অনাচার ও অবিচারে জড়িয়ে পড়ে। ফলে ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের আশা ধীরে ধীরে অন্য রূপ নেয়। ইহুদিরা অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে এমন একজন নেতার প্রত্যাশী যিনি তাদের হারানো শক্তি ও শান-শওকাত ফিরিয়ে আনবেন। ইহুদিরা নিজেকে হযরত মুসা (আঃ)’র অনুসারী বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু তারা হযরত মুসা (আঃ)’র পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ)সহ প্রতিশ্রুত মহামানব হযরত ঈসা (আঃ)’র আবির্ভাবের কথা তাওরাতে উল্লেখিত হওয়া সত্ত্বেও তা মেনে নেয় নি। ইহুদিরা খুব হেলাফেলায় পবিত্র গ্রন্থগুলোর এ সংক্রান্ত বাণী ও পূর্বাভাসগুলো উপেক্ষা করেছে। ইহুদিদের ইতিহাস থেকে জানা যায় তারা বিভিন্ন যুগে অশান্তি ও অনাচারে লিপ্ত ছিল এবং বিভিন্ন সংকট বা দুর্যোগ সৃষ্টির কাজে তারা নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে।

 বর্তমান যুগেও আমরা দেখছি ইহুদি নামধারী ইহুদিবাদীরা যুদ্ধ ও অশান্তির আগুন জিইয়ে রেখেছে। ধার্মিক ইহুদিরা এ পরিস্থিতিতে দুঃখিত হলেও তাদেরই স্বজাতি অধিকৃত ফিলিস্তিনে অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে এবং তারা সেখানে নিরপরাধ ও মজলুম ফিলিস্তিনীদের রক্তপাত অব্যাহত রেখেছে।

যরথুস্ত্র ধর্মেও শেষ যুগে বা আখেরি যামানায় প্রতিশ্রুত মহাপুরুষ বা ত্রাণকর্তা আসার ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। এ ধর্মে বিশ্বাসীদের গ্রন্থ জিন্দ ও আভেস্তায় এই প্রতিশ্রুত মহাপুরুষের নাম সুশিয়ান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুশিয়ান্ত শব্দটির অর্থ হলো কল্যাণকর। মুক্তিদাতা এই মহাপুরুষের দায়িত্ব হলো অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। যরথুস্ত্ররা মনে করেন, সুশিয়ান্তের আগমন ঘটলে সারা বিশ্বে ন্যায়বিচার ছড়িয়ে পড়বে। যরথুস্ত্রের জামাতা জামাসপের বইয়ে বলা হয়েছে,“ আরবদের মধ্য থেকে এক মহাপুরুষ আবির্ভূত হবেন। এই মহাপুরুষ হবেন তাঁর পূর্বপুরুষের ধর্মের অনুসারী। তিনি পৃথিবীকে ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ করবেন এবং তাঁর ন্যায় বিচার হবে এতটা প্রবল যে তখন মেষ ও নেকড়ে একত্রে পানি পান করবে। অর্থাৎ সবল ও দুর্বল একইসাথে বসবাস করবে।”

জিন্দ গ্রন্থে বলা হয়েছে,  “সে সময় মহান প্রভুর পক্ষ থেকে বিরাট বিজয় অর্জিত হবে এবং অশুভ শক্তি নির্মূল হবে। আহরিমানদের শক্তি তথা অশুভ শক্তি শুধু পৃথিবীতে সীমিত। আকাশে তাদের কোনো স্থান নেই। প্রভু বা স্রষ্টার বিজয়ের পর অশুভ শক্তি ধ্বংস হওয়ায় বিশ্ব প্রকৃত মুক্তির স্বাদ ফিরে পাবে এবং মানবজাতি সৌভাগ্যের সুখশয্যায় বসবাস করবে।”#

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ