ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৪ ০৯:৩৯ Asia/Dhaka

খ্রিস্ট ধর্মেও শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে আমরা আলোচনা শুনেছি গত দুই পর্বে। বিকৃত হয়ে যাওয়া খ্রিস্ট ধর্মে শেষ ত্রাণকর্তা সংক্রান্ত কিছু কিছু ধারণা ইসলাম ধর্মে উল্লেখিত বর্ণনার সঙ্গে মিল রাখে।

তবে খ্রিস্ট ধর্মে শেষ ত্রাণকর্তা বিষয়ক অনেক বর্ণনাই অস্পষ্ট। অন্যদিকে খ্রিস্ট ধর্মের আধুনিক যুগের একটি গোষ্ঠী যা ইহুদিবাদী খ্রিস্টবাদী বা ইভাঞ্জেলিস্ট গ্রুপ নামে কুখ্যাত তারা শেষ ত্রাণকর্তা সংক্রান্ত অনেক বানোয়াট ধারণা প্রচার করছে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে সহায়তা দেয়ার স্বার্থে ও নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রগুলো এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে। ইহুদিদের মধ্যেও শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ধর্মগ্রন্থেও শেষ যামানায় ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সুসংবাদ রয়েছে। 

ইহুদিদের ত্রাণকর্তার নাম মশিয়াহ বা মশীহ। অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী এই ব্যক্তি হযরত দাউদ (আ')'র কথিত বংশধর। হযরত দাউদ (আ) ছিলেন আল্লাহর নবী ও ইহুদি বাদশাহদের অন্যতম। মশিয়াহ বা মশীহ সব যুগেই জন্ম নেন এবং তিনি জীবিত আছেন। ত্রাণকর্তার ভূমিকা রাখতে তিনি প্রস্তুত, তবে সমাজকে তার আবির্ভাবের জন্য যোগ্য বা প্রস্তুত হতে হবে। সেই প্রস্তুতি বা যোগ্যতা থাকলেই আল্লাহ তাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে পাঠান। ইহুদিরা যুগে যুগে নানা সংকট ও সমস্যার শিকার হয়েছে। আর এ জন্যই তারা ত্রাণকর্তার ধারণায় বিশ্বাসী বলে অনেকে মনে করেন। হযরত ইশাইয়ার যাত্রা শীর্ষক ইহুদি ধর্মগ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের ৫ নং বাক্যে, মশীহকে একটি চারাগাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে: "এবং জেসির তথা হযরত দাউদের পিতার কাণ্ড থেকে একটি চারা বের হবে এবং সেখান থেকে একটি শাখা গজাবে। আল্লাহ বা স্রস্টার আত্মা তার উপর ভর করবে; এর অর্থ  তার মধ্যে থাকবে প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং উপলব্ধির আত্মা, পরামর্শ ও শক্তির আত্মা, এ ছাড়াও থাকবে জ্ঞানের চেতনা ও খোদার ভয়।» 

হযরত ঈসার (আ) যুগের ইহুদি পুরোহিতরা মনে করতেন, ঈসা নবীই প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তা। কিন্তু ঈসা নিজেকে আল্লাহর নবী বলে ঘোষণা করেন এবং জানান যে তিনি হযরত দাউদের বংশধর নন। তিনি বিরোধীদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ও তাদেরকে হত্যার পরিবর্তে জনগণকে সদুপদেশ ও সুপথ দেখানোর কাজ করতেন। ফলে ইহুদিরা ঈসা নবীকে পরিত্যাগ করে। এমনকি তারা নিজ নিজ সুবিধা ও ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ঈসা নবীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু করে ও শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু একদল মানুষ ঈসার প্রতি ঈমান আনে ও তাঁর পথ অনুসরণ অব্যাহত রাখে। এরাই খ্রিস্টান নামে পরিচিত। তাওরাতে বেশ কয়েকবার  প্রতিশ্রুত ত্রাণকর্তার আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ইহুদি ধর্মমতে শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের জন্য ইহুদিদেরকে হতে হবে খুবই ধার্মিক ও ঈমানদার। তাদেরকে গুনাহর জন্য তওবা করতে হবে এবং ইবাদত বন্দেগির দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। তাওরাতে এসেছে, ইহুদিদেরকে সব সময় শেষ ত্রাণকর্তার আগমনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে হতাশ হওয়া যাবে না।

হাবাক্কুক নামক নবীর বইয়ে বলা হয়েছে, উনি দেরিতে আসলেও তার জন্য অপেক্ষা করবে। কারণ তিনি অবশ্যই আসবেন এবং দেরি করবেন না... তিনি তার কাছে বহু জাতিকে সমবেত করবেন।..(দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় থেকে পঞ্চম বাক্য) ইহুদি ধর্মেও শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সময় নির্ধারণ করাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  ইহুদি ধর্মের দৃষ্টিতেও শেষ ত্রাণকর্তার আগমনের প্রাক্কালে পৃথিবী যুদ্ধ-সংঘাত, রোগ, পাপাচার, দারিদ্র ও দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে এবং আধ্যাত্মিকতা বলতে তেমন কিছু থাকবে না। এ সময় ইহুদিরা তাদের প্রতিশ্রুত ভূমি তথা ফিলিস্তিনে জড়ো হবে এবং এখন যেখানে মসজিদুল আকসা রয়েছে তার ধ্বংসস্তূপের ওপর আবারও সুলায়মানের ইবাদত-কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। অবশেষে ইয়াজুজ মাজুজ নামক দুর্বৃত্ত প্রকৃতির লোকদের বিশাল বাহিনীর হামলার মধ্য দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের কাছে আরমাগেড্ডনের যুদ্ধ শুরু হবে। সাত বছর ধরে চলবে এই যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ নিহত হবে। অবশেষে আল্লাহর হস্তক্ষেপের সুবাদে ইয়াজুজ মাজুজের বাহিনী পরাজয় বরণ করবে। এরপর শুরু হবে সারা বিশ্বের ওপর মশিয়াহ বা মশীহের রাজত্ব (ঈসা মাসিহ'র নয়)। মশীহ কেবল ইহুদিদেরই রক্ষা করবেন বা তাদের মুক্ত করবেন। তিনি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের বিষয়ে পরীক্ষা বা বাছ-বিচারের পর পাপী হিসেবে সাব্যস্ত একদলকে দোযখ বা নরকে পাঠাবেন।

মশিহ বা মশিয়াহ'র রাজত্বের যুগে ব্যাপক কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং আধ্যাত্মিকতা বিরাজ করবে।  তবে কেবল ইহুদিরাই এসবের অধিকারী হবে এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা তাদের কর্তৃত্বাধীনে থাকবে তাদের সেবক হিসেবে। এ যুগে বস্তুগত সমৃদ্ধি হবে অকল্পনীয় মাত্রায় বেশি।  মশিহ বা মশিয়াহ'র রাজত্বের যুগে নিরাপত্তা ও ভ্রাতৃত্ব এত জোরদার হবে যে বাঘ, নেকড়ে ও মেষ শাবক পাশাপাশি চরবে এবং দুধের শিশুরা সাপের গর্তের মুখে খেলা করবে! মানুষের মধ্যে কায়েম হবে ন্যায়বিচার। এ সময় মানুষেরা হয়ে পড়বে ধার্মিক এবং কেউ পাপ করবে না। কারণ মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলা হবে এবং অপবিত্র আত্মাগুলো হবে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত । 

ত্রাণকর্তা বা শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ইহুদিদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও ভাগ্য-নির্ধারণী বিষয়। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ইহুদিবাদ নামের এক আন্দোলন গড়ে তোলে একদল উগ্র ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। এরা ব্রিটেন ও মার্কিন সরকারের সহায়তায় সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও জবরদখলের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে গড়ে তুলেছে অবৈধ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র। তারা এই রাষ্ট্রকে তাদের ধর্মগ্রন্থের প্রতিশ্রুত ইহুদি রাষ্ট্র বলে দাবি করছে। তারা সুলায়মানের ইবাদত-কেন্দ্র নির্মাণের অজুহাতে আল-আকসা মসজিদ ধ্বংসের চেষ্টা করছে। বিকৃত হয়ে যাওয়া তাওরাতের উদ্ধৃতি দিয়ে তারা বলতে চায় যে ফিলিস্তিনে তাদের সমবেত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ যাতে সুলায়মানের ইবাদত-কেন্দ্র আবারও গড়ে তোলা যায়!  মিশরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফোরাত নদী পর্যন্ত অঞ্চলের দেশগুলো তারা দখল করতে চায়। তবে ইসরাইল এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে দুর্বল হয়ে গেছে। তাই ফিলিস্তিনের মুক্তি এখন আর হয়তো বেশি দূরে নয়। যুদ্ধকামিতা ও রাজনৈতিক লোভের কারণে ইহুদিবাদীদের শেষ ত্রাণকর্তার ধারণাগুলো মারাত্মক আঘাতের শিকার হচ্ছে। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ