মে ১১, ২০২৪ ২১:১০ Asia/Dhaka

প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তা ও বিশ্ব-সংস্কারকের অস্তিত্বের অপরিহার্যতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি গত কয়েক পর্বে। বেশিরভাগ ধর্ম ও মতাদর্শেই যে শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কে ধারণা রয়েছে তা আমরা তুলে ধরেছি বিগত পর্বগুলোর আলোচনায়।

এসব ধারণা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শেষ ত্রাণকর্তা হবেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মহামানব এবং ধর্মগুলোর দৃষ্টিতে তিনি ঐশী বা আসমানি ব্যক্তিত্ব। কোনো কোনো ধর্ম বা মতাদর্শের বক্তব্য অনুযায়ী শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পটভূমির এক বড় দিক হচ্ছে সে সময় ব্যাপক রক্তপাত ও সহিংসতা ঘটবে। কোনো কোনো ধর্মে শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সময় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেইসব তারিখ বা দিনক্ষণের লক্ষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ওইসব তারিখ হয় অতিক্রান্ত হয়েছে অথবা সেইসব তারিখ বা দিন আসতে এখনও অনেক বেশি সময় বাকি। ফলে অনেকেই এখন এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে যে বর্তমান যুগে বৈষম্য, জুলুম, সংঘাত ও দারিদ্র যত বেশিই হোক না কেন শেষ ত্রাণকর্তা খুব নিকটবর্তী সময়ের মধ্যেই আসবেন না। 

কোনো কোনো ধর্মের দৃষ্টিতে শেষ ত্রাণকর্তা কেবল বিশেষ জাতি বা বংশের লোকদের জন্যই আসবেন, অন্যান্য জাতি বা গোত্রের লোকদের নিয়ে তাঁর কোনো কাজ নেই। অন্যান্য জাতির মানুষেরা হয় নিহত হবে অথবা মুক্তি-প্রাপ্ত জাতির সেবক হবে। তবে কেবল ইসলাম ধর্ম ছাড়া  অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শে শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত যেসব ধারণা দেয়া হয়েছে সেসবের তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র বা উৎস নেই। আসলে বেশিরভাগ ধর্মগ্রন্থের বেশিরভাগ বাণীই বিকৃত হয়ে গেছে।  তাই অনেক ধর্ম ও গোষ্ঠীর অনুসারীরা শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চিত্র তুলে ধরেছে। আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য ও বর্ণনাগুলো নিয়ে কথা বলব। 

জনসংখ্যার দিক থেকে খ্রিস্ট ধর্মের পরই ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে শেষ ত্রাণকর্তা তথা ইমাম মাহদি (আ) সংক্রান্ত অনেক স্পষ্ট ও বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ইসলাম ধর্মের এই বর্ণনাগুলো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য ও যৌক্তিক। এসব বর্ণনায় কোনো স্ববিরোধিতা ও বিকৃতি নেই।

 পবিত্র ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে শেষ ত্রাণকর্তা হলেন হযরত ইমাম মাহদি (আ.)। তিনি শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র বংশধারার সদস্য। উনি মানুষ হিসেবে অন্য সবার মত হলেও নৈতিক উচ্চতর গুণগুলো যেমন, খোদাভীতি বা খোদা-সচেতনতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সতর্কতা, অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি, ইসলামী বিধি-বিধান ও সেসবের বাস্তবায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানসহ ইসলামের প্রাণ-সঞ্জীবনী সব ধরনের শিক্ষা, সাহসিকতা, সুবিবেচনা, জনগণের প্রতি, বিশেষ করে নির্যাতিতদের প্রতি গভীর দয়া এবং জালিমের প্রতি অত্যন্ত কঠোরতার মত গুণগুলো তাঁর মধ্যে নজিরবিহীন মাত্রায় বিদ্যমান। এসব বৈশিষ্ট্য তাঁর আত্মপ্রকাশের সময় থেকেই স্পষ্টভাবে দেখা যাবে তাঁর মধ্যে। অন্য কথায় তিনি একজন পরিপূর্ণ মহামানব। 

অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শগুলোর বিপরীতে ইসলাম ধর্মের বর্ণনাগুলোয় শেষ ত্রাণকর্তা তথা ইমাম মাহদি (আ)'র আগমনের আগের ও পরের পরিবেশ এবং তার আগমনের জন্য অপেক্ষারতদের দায়িত্ব সম্পর্কে অনেক বিশদ ও স্পষ্ট আলোচনা রয়েছে। ইমাম মাহদির বিষয়ে নানা কুসংস্কার ও অযৌক্তিক বক্তব্য এবং তাঁর ব্যাপারে নানা অমানবিক ঘটনার সংশ্লিষ্টতার অস্তিত্ব ইসলামী বর্ণনাগুলোতে দেখা যায় না। ইমাম মাহদির সব কাজই হবে ইসলামের আলোকিত শিক্ষা-ভিত্তিক। মানুষকে আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক বা বস্তুগত দিক থেকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেয়াই তাঁর কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য। আসমানি ধর্মগুলো, বিশেষ করে ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্ম ইব্রাহিমি ধারার ধর্ম হওয়ায় এ তিন ধর্মের শিক্ষা ও বিধি-বিধানগুলোয় পুরোপুরি মিল থাকার কথা। কিন্তু যুগে যুগে ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষায় নানা বিচ্যুতি ও বিকৃতি তথা ভিত্তিহীন ও ভুল অনেক বিষয় প্রচলিত হয়েছে এ দুই ধর্মের নামে। খ্রিস্টানদের বাইবেলের নানা সংস্করণ লেখা হয়েছে হযরত ঈসার যুগের বহুকাল পর। তাওরাতও নানাভাবে বহু বিকৃতির শিকার হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন নাজিলের সময় থেকে এ পর্যন্ত বিন্দুমাত্রও বিকৃতির শিকার হয়নি। তাই এই তিন ধর্মেই শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত ধারণাগুলোয় অনেক মিল এবং অমিলও দেখা যায়। 

ইহুদিদের শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কিত কোনো কোনো ঘটনার বর্ণনা যা ভবিষ্যতে ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা ইমাম মাহদির (আ.) আবির্ভাব সংক্রান্ত ইসলামী বর্ণনাগুলোর প্রায় অনুরূপ।  পবিত্র কুরআনে সুরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি  সতর্কবাণী বা উপদেশের পর যবুরে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাগণ অবশেষে পৃথিবীর অধিকারী হবে। একই ধরনের বক্তব্য রয়েছে তাওরাতে হযরত দাউদের মুনাজাতে যা যাবুর হিসেবে পরিচিত, যেমন বিশ্বাসীরা হবে পৃথিবীর ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী এবং তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। একই বইয়ের অন্য এক অংশে বলা হয়েছে, হে খোদা তোমার বিধি-বিধান দাও মালিককে ও তোমার ন্যায়বিচার অর্পণ কর মালিকের পুত্রকে যাতে তোমার জাতিকে ন্যায়বিচারও তোমার দরিদ্রদের ন্যায়ের মাধ্যমে শাসন করা যায়। -এ বক্তব্য ইমাম মাহদি (আ) সম্পর্কিত ইসলামী বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। একই বইয়ে বনি ইসরাইলের কোনো কোনো নবীর পক্ষ থেকেও একই ধরনের বক্তব্য রয়েছে শেষ জামানার ত্রাণকর্তা সম্পর্কে। 

বাইবেলের কোনো কোনো বর্ণনায় 'মানুষের সন্তান' বলে যেসব উদ্ধৃতি রয়েছে সেসবকেও আসলে ইমাম মাহদি সম্পর্কিত বক্তব্য বলে মনে করা যায়। খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আ)কে শেষ ত্রাণকর্তা বলে মনে করে। কিন্তু বাইবেলের প্রায় ৮০টি স্থানে শেষ ত্রাণকর্তাকে 'আদমের সন্তান' বলে উল্লেখ করা হয়েছে! এসবের মধ্যে কেবল ত্রিশটি স্থানে 'আদমের সন্তান' হযরত ঈসার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আর ৫০টি স্থানে আদমের সন্তানের যেসব বর্ণনা রয়েছে সেগুলো হযরত ইমাম মাহদির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। তাই এটা স্পষ্ট এসব স্থানে আসলে ইমাম মাহদির (আ) নামই দেয়া ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে সেই নাম বাদ দেয়া হয়েছে।  #

পার্সটুডে
    
 
 

ট্যাগ