মে ০৮, ২০২৪ ২০:০৬ Asia/Dhaka
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইরান: ইন্দো-ইরানীয় সম্পর্কের চমৎকার সেতুবন্ধন
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইরান: ইন্দো-ইরানীয় সম্পর্কের চমৎকার সেতুবন্ধন

পার্সটুডে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক। তিনি প্রেরণা লাভের জন্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের দিকেও দৃষ্টি দিতেন। তিনি ইরানীদের উপনিবেশিকতা বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করেছিলেন। এ বিষয়টি ইরানের প্রতি তার পারিবারিক আগ্রহের পাশাপাশি ইরান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের সুন্দর একটা ক্ষেত্রও সৃষ্টি করে।

"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" একজন লেখক এবং দার্শনিক হিসাবে শুধুমাত্র ভারতেই নয় সারা বিশ্বে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলেছিলেন। পশ্চিমের সাথে ঠাকুরের যোগাযোগ এবং তার ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে তেমন কোনো লেখাজোখা চোখে পড়ে না। সেটা হল ইরানের সাথে তার নিবীড় সংযোগের বিষয়। ভারতের সাথে ইরানের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আড়াই হাজার  বছরেরও বেশি প্রাচীন। আমরা এ সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ইরানী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। তাঁর দার্শনিক পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং ইরানের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ছিল। তিনি তাঁর প্রতিদিনের প্রার্থনায় উপনিষদ পাঠ করার পাশাপাশি পারস্যের কবি হাফেজের কবিতাও আবৃত্তি করতেন। তাই কিশোর বয়সেই ইরানি কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটেছিল।

শিরাজে বিখ্যাত ইরানী কবি হাফিজের সমাধি (বিংশ শতাব্দি প্রথম দিকে)

পারসিকদের প্রাচীন ধর্ম জরথুষ্ট্রবাদের প্রতিও ঠাকুরের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি   জরথুষ্ট্রকে "মহান অগ্রগামী নবী" বলে প্রশংসা করেছিলেন। তিনি জরথুস্ট্রিয়ান এবং হিন্দু ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য নির্দেশ করেছিলেন। বিশেষ করে প্রার্থনা এবং বলিদানের ক্ষেত্রে। ইরানে জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম এখনও বিদ্যমান এবং ইরানের জরথুষ্ট্রিয়ানরা সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয় ইত্যাদি নির্বিশেষে ইরানের সংসদ মজিলিসে শুরায় প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে ইরানের শাসন ব্যবস্থায় ভূমিকা পালন করে।

এইচ কে শেরওয়ানির "স্টাডিজ অন ইন্ডিয়াস ফরেন রিলেশনস" (১৯৭৫) বইয়ের ডক্টর "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" ও ইরান শিরোনামের একটি অধ্যায়ে লেখক ডঃ "মোহাম্মদ তাগি মোক্তাদারি" একটি আকর্ষণীয় বিষয় উত্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন: মুজাফরুদ্দিন শাহ কাজারের শাসনামলে কলকাতায় ইরানের অনারারি কনসাল ছিলেন সুমার কুমার ঠাকুর নামে ঠাকুর পরিবারের একজন দূরের আত্মীয়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় ইরানের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা কতোটা নিবীড় ছিল।

যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রাচ্যের প্রথম ব্যক্তি যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। তাই ইরানী অভিজাত শ্রেণী তাঁর সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। কর্নেল মোহাম্মদ তাকি খান পেসিয়ান ছিলেন ইরানের একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক সংস্কারক ও নামকরা একজন অফিসার। বার্লিনে থাকাকালীন ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে তিনি ঠাকুরের কবিতা ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।

ঠাকুরের সঙ্গে ইরানি লেখকদের সাক্ষাৎ

১৯৩১ সালে ইরানের সংবাদপত্রগুলি ঠাকুর সম্পর্কে নিবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করে এবং জনপ্রিয় এই ভারতীয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানার সুযোগ বৃদ্ধি করে।

ঠাকুর ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং অনুপ্রেরণার জন্য তিনি এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর দিকেও দৃষ্টি দিতেন। তিনি ইরানীদের উপনিবেশবাদ বিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করেছিলেন। ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুর প্রথমবার ইরান ভ্রমণ করেছিলেন। বু'শেহরে অবস্থান করার পর তিনি শিরাজ ভ্রমণ করেন এবং সেখানে ফার্সি মহান কবি হাফিজ ও সাদির কবর পরিদর্শন করেন। সেখানে পার্সপোলিসের প্রাচীন স্থাপনাও পরিদর্শন করেন ঠাকুর। তিনি ইসফাহান এবং তেহরানও ভ্রমণ করেন।

ইরানী সংসদ সদস্যদের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ (১৯৩২)

যেখানেই যাত্রাবিরতি করেছেন সেখানেই তিনি বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করেছেন। ঠাকুর, স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে তার আলাপ আলোচনায় ভারত ও ইরানের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সংযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

ঠাকুর তার ৭০তম জন্মদিনে তেহরানে এসেছিলেন। বিখ্যাত ইরানী কবি মালিক আল-শোয়ারা বাহার (ডিসেম্বর ১০, ১৮৮৬- ২২ এপ্রিল, ১৯৫১)  তেহরানে তাঁকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ঠাকুরকে উৎসর্গ করে তাঁর লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা পড়েন।

ঠাকুরের সঙ্গে ইরানের একদল লেখকের সাক্ষাতের ছবি

এই কবি আলী দাশতি, রশিদ ইয়সামি, আব্বাস ইকবাল, সায়িদ নাফিসি এবং নাসরুল্লাহ ফালসাফির মতো সেই সময়ের বিখ্যাত ইরানী পণ্ডিতদের সাথেও পরিচিত হয়েছিলেন।একইভাবে রবীন্দ্রনাথ  প্রথমে মাসুদিয়া প্রাসাদের হলে এবং তারপর ইরানী সাহিত্য সমিতিতে বক্তৃতা দেন। মাত্র দুই বছর পর ঠাকুর দ্বিতীয়বার ইরান ভ্রমণ করেন। এই সময় এসেছিলেন ইরানী মহাকবি ফেরদৌসির সহস্রতম জন্মবার্ষিকীতে ফেরদৌসির সমাধিস্তম্ভ উন্মোচন অনুষ্ঠানে। ইরানে তাঁর এই সফরের ঘটনাটি মিডিয়ায় খুব বেশি ফলাও হয় নি।

ইরান সফরের সময়, ঠাকুর ভারতে ফার্সি সাহিত্য পড়াতে একজন অধ্যাপক পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর অনুরোধে ইব্রাহিম পোরদাউদ নামের একজন ইরানী পণ্ডিতকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তিনি প্রাচীন ইরানী সাহিত্য শিক্ষা দিতেন।

এছাড়াও তিনি জিয়াউদ্দিন নামের স্থানীয় শিক্ষকের সহায়তায় ঠাকুরের অনেক কবিতা বাংলা থেকে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৯৩৫ সালে কলকাতায় সংকলনটি প্রকাশ করেন। ইরানী নওরোজ উদযাপনের জন্য ঠাকুর জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি ইরানি সংস্কৃতি, ইরানি সভ্যতা, ইরানি জনগণ এবং তাদের আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি দুই দেশ এবং দুই সভ্যতার মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছিলেন।

দু'দেশের মধ্যে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক সম্পর্ক-যার প্রেক্ষাপট ছিল কয়েক হাজার বছরের-যথারীতি দৃঢ় ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর ইরান ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখে। একইসাথে ভারত উপমহাদেশ থেকে আলাদা হয়ে সৃষ্ট পাকিস্তানের সাথেও একটি নতুন প্রতিবেশী হিসেবে সম্পর্ক রাখে। অপরদিকে ভারতও ১৯৭৯ সালে পশ্চিমা মদদপুষ্ট পাহলাভি রাজবংশের পতনের ফলে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখে।

২০১১ সালে হাউস অফ কমন্স অফ ইন্ডিয়া বা ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সাবেক স্পিকার মীরা কুমার ইরান সফর করার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার একটি ফার্সি সংস্করণ উন্মোচন করা হয়।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার ফারসি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে মিসেস "মীরা কুমার" এবং ইরানের পার্লামেন্টের তৎকালীন স্পিকার "আলি লারিজানি"

পার্সটুডে/এনএম/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ