মার্চ ০৬, ২০২৪ ০৯:৩২ Asia/Dhaka

ইসলামের দৃষ্টিতে মায়ের মর্যাদা ও দায়িত্ব সংক্রান্ত গত পর্বের আলোচনার প্রেক্ষাপটে আজ আমরা বিশ্বখ্যাত কয়েকজন আদর্শ মায়ের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।

পবিত্র কুরআন পবিত্র ও আদর্শ নারীদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। মহানবী (সা) যে চার জন আদর্শ বা শ্রেষ্ঠ নারীর কথা উল্লেখ করেছেন তাঁরাও পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত আদর্শ তথা শ্রেষ্ঠ নারী। মহানবীর (সা) উল্লেখিত চার শ্রেষ্ঠ নারী হলেন, হযরত আসিয়া, বিবি মারিয়াম, হযরত খাদিজা ও হযরত ফাতিমা।  তাঁদের মধ্যে হযরত ফাতিমা হলেন সর্বকালের সেরা নারী। অন্য কথায় এ চারজন নারী হলেন সর্বকালের সেরা চার মাতা। ফেরাউন স্বপ্ন দেখেছিল এক নবজাতক তাঁর ক্ষমতা ও রাজত্বের জন্য হুমকি হবে। ফলে ক্ষমতা ও রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে ফেরাউন দেশর সব নবজাতককে হত্যার পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত মুসা (আ) এই হত্যাযজ্ঞ থেকে নিরাপদ থাকেন। এর কারণ মহান আল্লাহ হযরত মুসার মা ইয়োকোবাদকে প্রত্যাদেশ দিয়েছিলেন যে তিনি যেন নবজাতক মুসাকে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। এ প্রত্যাদেশ দেয়া হয় অন্তরে অনেকটা অনুপ্রেরণার মতো।

 কিন্তু একজন মা হিসেবে মুসা নবীর মায়ের জন্য ফেরাউনের সেনাদের হাত থেকে সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর বিষয়টি ছিল গভীর উদ্বেগের বিষয়। সুরা কাসাস-এর সাত নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি মুসা-জননীকে আদেশ পাঠালাম যে, তাকে স্তন্য দান করতে থাক। অতঃপর যখন তুমি তার সম্পর্কে বিপদের আশংকা কর, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে পয়গম্বরগণের একজন করব।–এরপর একই সুরার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: অতঃপর আমি তাকে জননীর কাছে ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চক্ষু জুড়ায় এবং তিনি দুঃখ না করেন এবং যাতে তিনি জানেন যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, কিন্তু অনেক মানুষ তা জানে না।

মহান আল্লাহ তাঁর দাসদের প্রতি সবচেয়ে বেশি দয়ালু। তিনি মুসার মায়ের অন্তরের খবর জানতেন বলেই তাঁর হৃদয়কে প্রশান্ত রাখতে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে নবজাতক পুত্রের জীবনের নিরাপত্তার জন্যই তিনি যেন তাকে পানিতে ভাসিয়ে দেন এবং এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় না ভোগেন। মহান আল্লাহ নবজাতক মুসাকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ওয়াদাও দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ সেই ওয়াদা পূরণও করেছেন। আর এসব ঘটনায় হযরত মুসার মা ইয়োকোবাদের উচ্চ মর্যাদা ফুটে উঠেছে। ইয়োকোবাদ মহান আল্লাহর ওয়াদার যে কোনো খেলাপ হবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত ঈমানের অধিকারী ছিলেন বলেই সন্তানকে নীল নদে ভাসিয়ে দিতে পেরেছিলেন। হযরত ইমরানের স্ত্রী হান্নাও ছিলেন একজন আদর্শ মাতা। পবিত্র কুরআনের (সুরা আলে ইমরানের ৩৫ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াতের) বর্ণনা অনুযায়ী তিনি একনিষ্ঠ চিত্তে এই নিয়ত করেছিলেন যে নিজ গর্ভের সন্তান জন্ম নেয়ার পর তাঁকে আল্লাহর ঘর তথা ইবাদাত-কেন্দ্রের খাদেম করবেন। তিনি যখন দেখলেন যে তার একটি কন্যা সন্তান হয়েছে তখন তিনি তাঁর নাম রাখলেন মারিয়াম এবং তাঁকে আল্লাহর ঘরের খাদেম হিসেবে পাঠালেন।

গত শতকের প্রথমদিকে মক্কায় হযরত খাদিযার (সা.আ) পবিত্র মাজার। সৌদি ওয়াহাবি সরকারের নির্দেশে পরে এই মাজার ভেঙ্গে ফেলা হয়

মারিয়ামকে মহান আল্লাহ নির্বাচিত নারী বলে কুরআনে ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় পিতা ছাড়াই তাঁর মা হওয়াও গৌরবের বিষয়। মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে অন্যতম সেরা নবী হযরত ঈসার মাতা হযরত মারিয়াম যে অত্যন্ত উচ্চ-মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তা বোঝা যায় সুরা আলে ইমরানের ৩৭ নম্বর আয়াত থেকে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: অতঃপর তাঁর পালনকর্তা তাঁকে উত্তম ভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাঁকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন-অত্যন্ত সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তাঁকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন।–অর্থাৎ মহান আল্লাহ নিজেই মারিয়ামকে লালন পালনের ভার নেয়ার কথা ও তাঁকে অসাধারণ উন্নতি দানের কথাও উল্লেখ করেছেন।  আসলে এসব কারণেই হযরত মারিয়াম সালামুল্লাহি আলাইহা ইতিহাসের সেরা চার নারীর একজন। 

মহানবীর (সা.) কন্যা হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহ আলাইহা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী গোটা বিশ্ব জগতের আধ্যাত্মিক মাতা। তাঁরই প্রশিক্ষণে গড়ে উঠেছেন জান্নাতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন এবং কারবালা বিপ্লবের সত্যিকারের ইতিহাস ও শিক্ষার প্রচারক হযরত যাইনাব। হযরত ফাতিমা স্বামীর সেবা ও সন্তানের লালন-পালনকে ইবাদাতের অন্যতম অংশ বলে মনে করতেন। সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যা যা করা দরকার তার সবই তিনি করতেন; যেমন, সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলা ও তাদের জন্য আদর্শ নির্ধারণ ইত্যাদি। ইসলামের প্রয়োজনে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করেছেন। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হযরত ফাতিমা (সা) স্ত্রী হিসেবে হযরত আলীর প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র এবং তাঁর জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষায় নিবেদিত। তাই হযরত ফাতিমার সঙ্গে মহান আলীর বিয়ের কিছুকাল পর মহানবী (সা) ফাতিমার আচরণের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথে আমি তাঁকে সর্বোত্তম সাহায্যকারী হিসেবে পেয়েছি। 

হযরত আলী ও ফাতিমা কখনও পরস্পরকে কষ্ট দেননি এবং তাঁরা পরস্পরকে কখনও কোনো কাজে বাধ্য করেননি। তাই তাঁরা ছিলেন পরস্পরের জন্য প্রশান্তির মাধ্যম। হযরত আলী (আ) বলতেন, ফাতিমার চেহারার দিকে তাকালেই সমস্ত দুঃখ-বেদনা ভুলে যেতাম! হযরত ফাতিমার সন্তানরা জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শিক্ষা পেয়েছেন তাঁদের নানা, বাবা ও মায়ের কাছেও। সন্তানরা বাহির থেকে ঘরে এলে হযরত ফাতিমা তাঁদের সম্বোধন করতেন 'আমার চোখের আলো' বলে।  নিজ যুগের মুসলিম নেতার প্রতি তথা আমিরুল মুমিনিনের প্রতি হযরত ফাতিমার ইস্পাত-দৃঢ় আনুগত্যও সবার জন্য শিক্ষণীয় আদর্শ যার প্রতিফলন আমরা দেখি হযরত যাইনাবের মধ্যেও।

হযরত ফাতিমা ও যাইনাবের উত্তরসূরি ইরানি মায়েদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই আজকের ইরানি যুব সমাজের অনেকেই শাহাদাতের মত বীরত্বপূর্ণ ত্যাগের সংস্কৃতির ধারক হতে পেরেছেন। আসলে সন্তানদের ধার্মিক ও চরিত্রবান করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা-বাবার প্রশিক্ষণ ও প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আমরা কারবালা বিপ্লবের মহানায়কের অন্যতম প্রধান সহযোগী হযরত আবুল ফজল আব্বাসের মাতা হযরত উম্মুল বানিনের আত্মত্যাগী ভূমিকার কথাও স্মরণ করতে পারি। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ