সুরা ইব্রাহিমের প্রাথমিক পরিচিত ও ব্যাখ্যা
সুরা ইব্রাহিম পবিত্র কুরআনের ১৪ তম সুরা। সাত রুকু ও ৫২ আয়াতের এই সুরার ২৮ এবং ২৯ নম্বর আয়াত ছাড়া অন্য সব আয়াত মক্কায় নাজিল হয়েছে।
এ সুরায় মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য মহান রাসূল হযরত ইব্রাহিম (আ.) সম্পর্কে নানা বক্তব্য এবং তাঁর একনিষ্ঠ দোয়া, সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির বর্ণনা থাকায় সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে ইব্রাহিম। হযরত নুহ ও হযরত মুসা (আ.)' এবং আদ ও সামুদ জাতির ঘটনাও স্থান পেয়েছে এই সুরায়।
কুরআনের বেশ কয়েকটি সুরার মত সুরা ইব্রাহিমের প্রথমেও রয়েছে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি অক্ষর। এইসব অক্ষরের অন্যতম সম্ভাব্য তাৎপর্য এটা যে সাধারণ বর্ণমালা দিয়েই রচিত হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন।অথচ এর বাক্যগুলো মানুষকে দেখায় সুপথ।
সুরা ইব্রাহিমের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
(১) 'আলিফ-লাম-রা; এই গ্রন্থ যা আমি তোমার প্রতি এ কারণে অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে (শিরক ও অজ্ঞতার) নানা অন্ধকার হতে বের করে তাঁর পথে বা আলোতে (তথা ঈমানর নুরের মধ্যে নিয়ে আস) যিনি পরাক্রমশালী ও প্রশংসিত।'
পবিত্র কুরআনের সমস্ত শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষকে নানা ধরনের বিভ্রান্তি, জুলুম, শিরক, কুফরি ও অজ্ঞতার আঁধার থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার, জ্ঞান ও ঈমানের ছায়াতলে নিয়ে আসা। নবী-রাসূলরাও এসেছেন এই একই উদ্দেশ্যে।
অন্য কথায় মানুষের মুক্তি ও সৌভাগ্য অর্জনের জন্য যা যা দরকার তার সবই রয়েছে কুরআনে। এই আয়াত এটাও মনে করিয়ে দেয় যে কুরআন কেবল বিনোদন ও জ্ঞান অর্জনের জন্য রচিত একটি বই নয়, বরং এতে রয়েছে মানব জীবনের সব ক্ষেত্রের ও তাদের চলার পথের পরিপূর্ণ গাইড। তাই প্রাত্যহিক জীবন হতে হব কুরআনের বিধান-সম্মত।
কুরআনের এই আয়াতে ও অন্য স্থানেও 'জুলুমাত' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বহুবচনে। এর অর্থ নানা ধরনের অন্ধকার। অন্যদিকে নুর বা আলো শব্দটি হল একবচন। অর্থাৎ আলো আর পবিত্রতা ও সব কল্যাণের উৎস হল তাওহিদ বা স্রস্টার একত্ব। সব আলো আর মঙ্গলের উৎস হলেন মহান আল্লাহ। আর এ জন্যই সরল পথ বা সত্যের পথ একটিই হয়ে থাকে। সব নবী-রাসূল যুগে যুগ এই একই পথ ও লক্ষ্যের অনুসরণ করেছেন। তাঁদের শিক্ষার মূলনীতি ছিল অভিন্ন। তাই সত্যের মধ্যেই রয়েছে ঐক্য ও ঐকতান। অন্যদিকে অজ্ঞতা আর মিথ্যার রয়েছে নানা রূপ। এসবই বিচ্ছিন্ন, অসংলগ্ন এবং পরস্পর-বিরোধী। এই আয়াত আমাদের এটাও শেখাচ্ছে যে যদিও কুরআন মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথ দেখায়। কিন্তু তা করা হয় একজন শিক্ষকের মাধ্যমে। আর এই শিক্ষক হলেন বিশ্বনবী (সা.)। ঈমানহীন মানুষ ডুবে আছে অন্ধকারের এক সংকীর্ণ আবর্তে। নবী-রাসুলরা তাদের মুক্ত করে নিয়ে যান আলোর প্রশস্ত, মুক্ত ও খোলা প্রান্তরের পথে। এই পথ হল আল্লাহকে পাবার পথ।
সুরা ইব্রাহিমের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
(৭) ''(স্মরণ কর,) যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেছিলেন, ‘যদি তোমরা (আমার প্রতি) কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদেরকে আমার নিয়ামত বেশি মাত্রায় দান করব; আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অতি কঠোর।’''
কৃতজ্ঞতা অতি উন্নত মানের নৈতিক গুণ। আল্লাহ তাঁর দানের অসীম পাত্র থেকে আমাদের যা দেন তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন। তবুও আমরা যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি তাহলে তিনি নেয়ামত বাড়িয়ে দেন।
কৃতজ্ঞতার স্তর হল ৩টি: প্রথমত এটা ভাবা যে কে আমাদের এতসব নেয়ামত দিয়েছেন? দ্বিতীয়ত মৌখিক স্বীকৃতি ও প্রশংসা এবং তৃতীয় স্তর হল নেয়ামতকে সেই উদ্দেশ্যে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ আমাদেরকে তা দিয়েছেন। আমাদের হাত, পা, চোখ, নাক ও পঞ্চেন্দ্রিয় ইত্যাদি দেয়া হয়েছে মহান আল্লাহর মহত্ত্বকে অনুভব করার জন্য যাতে সঠিক পথটি বেছে নিয়ে পূর্ণতায় উপনীত হওয়ার পদক্ষেপ নিতে পারি। আর এটাই হচ্ছে বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। আর এইসব অঙ্গকে যদি আমরা স্বার্থপরতা, আল্লাহর প্রতি উদাসীনতা, বিদ্রোহ ও পাপাচারে ব্যয় করি তাহলে তা হবে বাস্তব অকৃতজ্ঞতা। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, 'ন্যুনতম কৃতজ্ঞতা হল আল্লাহর দেয়া নেয়ামতে সন্তুষ্ট থাকা এবং নেয়ামতকে পাপ ও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কাজে ব্যবহার না করা।'
আমাদের নানা শক্তি, সম্পদ, সামাজিক প্রভাব, সুস্বাস্থ্য- এসব কিছুকেই আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হলে তা হবে সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও দয়া-দাক্ষিণ্য বেড়ে যাবে।
বাগানের যে গাছ সতেজ হয় না এবং ফুল ও ফল দেয়, মালি সে গাছের বেশি যত্ন নেয়। আর যে গাছে পানি ঢেলেও লাভ হয় না, মালি এক সময় তা উপড়ে ফেলে বা কেটে নির্মূল করে দেয়। তবে মানুষ আর গাছের পার্থক্য হল গাছ নিজেকে বিকশিত করতে স্বাধীন বা সৃষ্টিশীল নয়, বরং প্রকৃতির বিধান মেনে চলে বাধ্য হয়ে। কিন্তু মানুষ বুদ্ধি ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সচেতনভাবে আল্লাহর নেয়ামতকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর যোগ্যতা রাখে। যে মানুষ আল্লাহর দেয়া শক্তি দিয়ে অন্যদের ওপর অবিচার করে সে আসলে এই শক্তি পাওয়ার যোগ্য নয়। আর যে সত্য ও ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের পথে শক্তিকে কাজে লাগায় সে যেন হৃদয়ের ভাষা দিয়ে এ কথাই বলে যে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার নেয়ামত ব্যবহারের যোগ্যতা রাখি। তাই আমার জন্য তোমার নেয়ামত বাড়িয়ে দাও।
যখন কোনো নেয়ামত পাওয়ার সুযোগ থাকে তখন আমরা যেন অকৃতজ্ঞ হয়ে নেয়ামতের পুরো প্যাকেজটিই মিস না করি। নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারাটাও এক বড় নেয়ামত। তাই আল্লাহ কৃতজ্ঞকে আরো নেয়ামত দেন এবং তা দেয়াকে নিজ দায়িত্ব বলে মনে করেন। আর এ জন্যই বলা হয়, আল্লাহর নেয়ামতের পুরোপুরি শোকর করার সাধ্য কারও নেই।
যারা কোনো সমাজের উন্নয়নের জন্য ও মানুষের উপকারের জন্য কষ্ট করেন তাদের প্রতি যদি কৃতজ্ঞতা দেখানো না হয় তাহলে অন্যরা মানবসেবার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বা কম আগ্রহী হবেন। আর যদি কৃতজ্ঞতা দেখানো হয় তাহলে সেবার মনোভাব বাড়তেই থাকবে।
এক হাদিসে এসেছে, 'যদি তুমি ইসলামের নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তবে ঈমানের নিয়ামত পাবে। আর যদি ঈমানের নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ হও, তবে মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য লাভ করবে এবং যদি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের নিয়ামতে কৃতজ্ঞ হও, তবে তাঁর নৈকট্যের স্থলে পৌঁছবে।'
সুরা ইব্রাহিমের ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
(১৮) 'যারা নিজেদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে তাদের কাজের দৃষ্টান্ত সেই ছাইয়ের মত যাকে ঝড়ের দিনে বাতাস প্রবল বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের অর্জিত বস্তুর ওপরও তাদের কোন ক্ষমতা থাকবে না; এবং এটাই দূরবর্তী ভ্রষ্টতা।'
যারা সত্যকে অস্বীকার করে তাদের সব কাজই ব্যর্থ হয়। একটি ছোট মাটির পাত্রেও একটি সুন্দর ফুল গাছ হতে পারে। কিন্তু কেবল ছাইভরা পাত্রে বা পোড়া মাটির বিশাল প্রান্তরেও কিছুই জন্মায় না। #