সুরা ইব্রাহিমের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা ইব্রাহিমের 21 নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, '(২১) (কিয়ামত দিবসে) সবাই আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, তখন দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা অহংকারীদের বলবে,
‘আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম, এখন তোমরা কি আল্লাহর শাস্তি হতে আমাদের কিছুটাও রক্ষা করতে পার?’ তারা বলবে, ‘যদি আল্লাহ আমাদের পথ প্রদর্শন করতেন, তবে আমরাও তোমাদের পথ প্রদর্শন করতাম। আমরা অধৈর্য হই অথবা ধৈর্যধারণ করি- আমাদের জন্য সমান; শাস্তি হতে আমাদের মুক্তির কোনো পথই নেই।’
অর্থাৎ দাম্ভিক জালিম ও কাফিরদের বোকা বা দুর্বল অনুসারীরা কিয়ামতের দিন তাদের নেতাদের বলবে, আজ আমাদের পাপের শাস্তির কিছু বোঝা তোমরা বহন কর। কারণ, তোমাদের অনুসারী হওয়ার কারণেই আজ আমাদের এতো দুর্ভোগ! তারা তখন বলবে, যদি আল্লাহ আমাদেরকে এই শাস্তির পথ থেকে মুক্তির দিকে পরিচালিত করতেন তাহলে আমরা তোমাদেরকে সেপথ দেখাতাম! তাই এখন অর্থহীন বিতর্ক করে লাভ নেই- মুক্তির আর কোনো উপায়ই এখন আর খোলা নেই।
কুরআনের এই আয়াত অনুযায়ী দাম্ভিক কাফির নেতারা রাজি হোক বা না হোক তাদেরকে তাদের অনুসারীদের পাপের বোঝা বইতে হবে। কারণ, তারাই বিভ্রান্ত করেছিল তাদের অনুসারীদের। অবশ্য তাদের অনুসারীদের শাস্তির মাত্রাও বিন্দু পরিমাণ কমানো হবে না। তাই এটা স্পষ্ট যারা অন্ধের মত কারো অনুসরণ করে ও যাচাই না করেই কাউকে নেতা হিসেবে মেনে নেয় তারাও তাদের নেতার মতই একই পরিণতি ভোগ করবে। পরের আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'(২২) যখন সমস্ত বিষয় নিষ্পত্তি হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং আমিও তোমাদের কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তবে তোমাদের ওপর তো আমার কোন আধিপত্য ছিল না। আমি কেবল তোমাদের আহ্বান করেছিলাম; আর তোমরা তা গ্রহণ করেছিলে। সুতরাং তোমরা আমাকে তিরস্কার কর না; বরং নিজেদের তিরস্কার কর। আজ না আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি, আর না তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পার, তোমরা যে অতীতে আমাকে (আল্লাহর সাথে) অংশী করেছিলে আমি তা অস্বীকার করছি।’ নিশ্চয়ই যারা অবিচারক তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
এ আয়াতে শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা দিলেও তার অনুসারী হতে মানুষকে বাধ্য করতে পারে না। মানুষই শয়তানের কথা বিশ্বাস করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। অবশ্য মানুষ নানা অপরাধ বা পাপে জড়িয়ে শয়তানের কুমন্ত্রণাকে অন্ধের মত মেনে নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
এর পরের আয়াতে বলা হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্মই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। এরপর ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: '(২৪) (হে রাসূল!) তুমি কি লক্ষ্য করনি, আল্লাহ কীভাবে পবিত্র বাণীর উপমা পবিত্র বৃক্ষের মাধ্যমে বিবৃত করেছেন, যার মূল সুদৃঢ় এবং এর শাখা-প্রশাখা আকাশ অবধি বিস্তৃত। (২৫) তা (এ বৃক্ষ) নিজ প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সব সময়ে ফলদান করে। এবং আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা উপস্থাপিত করেন যাতে তারা উপদেশ ও শিক্ষা নেয়।'
মহান আল্লাহ কলেমায়ে তাইয়্যেবাকে পবিত্র গাছের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ, এর রয়েছে বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি। এ গাছ সব দিক থেকেই পবিত্র। এর ফুল, ফল, শেকড় ও শাখা বা পল্লব এবং এমনকি সেখান দিয়ে যে বাতাস বয় তাও পবিত্র। এ পবিত্র বাক্যের মূল স্থায়ী ও এত সুদৃঢ় যে ঝড়-তুফান তা উচ্ছেদ করতে পারে না। এ গাছের শাখাগুলো আকাশে উন্নীত হয়েছে। এ গাছে সব সময়ই সুস্বাদু ও সুমিষ্ট ফল থাকে এবং হাত বাড়ালেই যে কেউ তা নিতে পারে সব যুগেই। নবী-রাসূলরা হচ্ছেন এ গাছের মূল, আর নবী-রাসূলদের প্রকৃত উত্তরসূরী বা ইমামদের মত নিষ্পাপ ব্যক্তিরা এর কাণ্ড বা শাখা। আর তাঁদের জ্ঞান হচ্ছে এর ফল ও তাঁদের অনুসারীরা এ গাছের পাতা।
সুরা ইব্রাহিমের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
'আর নোংরা বাক্যের উদাহরণ হলো নোংরা বা অপবিত্র গাছ। শেকড়বিহীন (এ গাছকে) মাটির উপর থেকে উপড়ে নেয়া হয়েছে। এর কোন স্থিতি নেই।'
কলেমায়ে খবিস বা নোংরা বাক্য বলতে অপবিত্র মানুষ ও তাদের নানা কর্মসুচিকে বোঝায় যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সব ধরনের অপবিত্র জিনিস বা বিষয় কলেমায়ে খবিসের অর্ন্তভুক্ত। শেকড়বিহীন, শুকনো ও কুৎসিত এ জাতীয় গাছের না আছে ফল না আছে ফুল, পাতা ও ছায়া। এ গাছ বড়ও হয় না এবং স্থায়ী ও সুদৃঢ় নয়। মানুষের উন্নতি বা চলার পথে বাধা ও ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনে না এ গাছ।
সুরা ইব্রাহিমের ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'(স্মরণ কর সে সময়ের কথা) যখন ইব্রাহীম বললেনঃ হে পালনকর্তা, এ শহরকে তথা মক্কাকে শান্তিময় ও নিরাপদ করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন।'
মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভিজ্ঞ হযরত ইব্রাহীম (আ.) সত্য-সন্ধানী মানুষের হৃদয়কে তৌহিদের বাণীর মাধ্যমে আলোকিত করেছেন এবং অজ্ঞতার আঁধারে ডুবে-থাকা একদল মানুষকে আলোর পথে এনেছেন।
বিবি হাজরার গর্ভে ইব্রাহিম (আ.)'র পুত্র ইসমাইল (আ.) জন্ম নেয়ায় এই মহান নবীর প্রথম স্ত্রী ইর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। ফলে মহান আল্লার নির্দেশে হাজরা ও শিশু ইসমাইলকে পাথুরে-পাহাড়ে ভরা মক্কার শুকনো ও তপ্ত প্রান্তরে রেখে আসেন ইব্রাহিম নবী। পানিশুন্য এ অঞ্চলে ঘাসও জন্মাত না। তৃষ্ণার্ত শিশুকে পানি দেয়ার জন্য মা হাজেরা এখানে ওখানে অনেক ছুটাছুটি করতে থাকেন। ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় ইসমাইলের পায়ের নীচ থেকে উথলে ওঠে জমজম নামক ঝর্ণা। পানির সন্ধান পাওয়ায় মরূচারী গোত্রগুলো এখানে বসতি গড়ে তোলে। মহান আল্লাহই চেয়েছিলেন এ অঞ্চলটি ইবাদতের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক।
মহান আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলের সহায়তায় এখানে কাবা ঘরের ভিত্তি গড়ে তোলেন। এরপর তিনি ওই দোয়াসহ ও নানা মুনাজাত পেশ করেন আল্লাহর দরবারে। একত্ববাদের এই কেন্দ্রে তথা কাবাঘরে ইবাদত করতে বিশ্বাসীদের আহ্বান জানান ইব্রাহিম (আ.)।
এ মহান নবীর দোয়ার আদাব ও কৌশলও শিক্ষণীয়। তিনি মক্কাকে নিরাপদ করার আর্জি পেশ করেছেন দোয়ার প্রথমেই। কারণ, যে কোনো শহরের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রথম শর্তই হল নিরাপত্তা আর শান্তি। এরপর তিনি চেয়েছেন তাঁর সন্তানরা যেন মূর্তিপূজা থেকে দূরে থাকে। আর এটা হল তাওহিদি বিশ্বাস ও কর্মসুচির মূল ভিত্তি। এরপর ইব্রাহিম নবী বলেছেন,
'হে পালনকর্তা, এরা অনেক মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার এবং কেউ আমার অবাধ্যতা করলে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামায কায়েম রাখে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফলাদি দিয়ে রুযী দান করুন, সম্ভবতঃ তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।'
দোয়ার এক পর্যায়ে ইব্রাহিম (আ.) আরও বলেছেন, "হে আমার পালনকর্তা, আমাকে নামায কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা, এবং কবুল করুন আমাদের দোয়া। হে আমাদের পালনকর্তা, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে।"
সুরা ইব্রাহিমের ৪২ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'জালেমরা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহকে কখনও বেখবর মনে করো না তাদেরকে তো ঐ দিন পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে রেখেছেন, যেদিন চক্ষুসমূহ ( সে দিনের ভয়াবহতা দেখে) বিস্ফোরিত হবে। মানুষকে ঐ দিনের ভয় প্রদর্শন করুন, যেদিন তাদের কাছে আযাব আসবে। তখন জালেমরা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে সামান্য মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, যাতে আমরা আপনার আহবানে সাড়া দিতে এবং পয়গম্বরগণের অনুসরণ করতে পারি। (তাদের বলা হবে) তোমরা কি ইতোপূর্বে কসম খেতে না যে, তোমাদেরকে দুনিয়া থেকে যেতে হবে না?'
এ দুই আয়াত থেকে বোঝা উচিত জালিমদের খুব আরামে ও বিলাসিতার মধ্যে জীবন যাপন করতে দেখে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ অত্যন্ত ধৈর্যশীল বলে জালিমদের শেষ পর্যন্ত সংশোধনের সুযোগ দেন। #