জুলাই ২৬, ২০১৬ ১৭:৩৯ Asia/Dhaka

নতুন একটি রূপকথার গল্প শুরু করবো আজ। গল্পটির নাম হলো চগুন দুজ। ইরানি ঐতিহ্যবাহী রূপকথার অন্তর্ভুক্ত এই গল্পেও আমরা লক্ষ্য করবো দেও-দানব আর নবী সোলায়মানের অলৌকিকত্বের দৃষ্টান্ত। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।

সে বহুদিন আগের কথা। এক ব্যবসায়ীর এক ছেলে ছিল। ছেলেটির নাম ছিল ইব্রাহিম। ব্যবসায়ী তার ছেলেকে পাঠালো মক্তবে। ছেলে তো মক্তবে যাওয়া আসা করছে,লেখাপড়া করছে। একদিন হলো কী! ছেলে মক্তব থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাদশার প্রাসাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। প্রাসাদ অতিক্রম করার সময় হঠাৎ তার নজর পড়ে গেল প্রাসাদের একটি খোলা জানালায়। ঘটনাক্রমে ওই জানালায় তখন বাদশার মেয়ে মানে শাহজাদি এসে দাঁড়িয়েছিল। ইব্রাহিমের চোখ চুম্বকের মতো লেগে গেল জানালায়। এক পলকেই তার চোখের সাথে মনও আটকে গেল শাহজাদির সঙ্গে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। শাহজাদিকে এক নজর দেখেই ইব্রাহিমের সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে না করবে-যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা হয়ে গেল তার।

মাথার ভেতর অপলক ভাব নিয়েই ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো ইব্রাহিম। বাসায় ফেরার পর মা তাকে দেখেই বুঝতে পারলো কোথাও গণ্ডগোল আছে। আলতো করে জিজ্ঞেস করলো: ‘বাবা! কী হয়েছে তোমার। কোনো সমস্যা? তোমাকে এমন লাগছে কেন? চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগছে। কেউ মেরেছে টেরেছে নাকি? কী হয়েছে,বল না বাপ’!

যতোই চেষ্টা করলো মা,কিছুতেই কাজ হলো না। ছেলের মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না। অগত্যা মা ছেলেকে তার অবস্থাতেই ছেড়ে দিলো। ছেলে বিশ্রাম নিলো। কিন্তু বিশ্রাম কোথায়। আধমরা হয়ে পড়ে থাকার মতো অবস্থা। কিছুক্ষণ এভাবে যাবার পর মা যখন বুঝলো ছেলে অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে,তখন মা ছেলেকে ভালো করে ধরলো। জিজ্ঞেস করলো: ‘সত্যি করে বল তো কী হয়েছে তোর’!

পৃথিবীর সবকিছুতেই ফাঁকি দেওয়া চলে কিন্তু মায়ের চোখ কিংবা মনকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। ইব্রাহিম যখন বুঝলো বিষয়টা,তখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। মায়ের পীড়াপীড়িতে বলতে বাধ্য হলো: ‘মক্তব থেকে বাড়ি ফেরার পথে আজ প্রাসাদের পাশ দিয়ে ফিরছিলাম। হঠাৎ প্রাসাদের একটি খোলা জানালায় শাহজাদিকে দেখতে পেলাম। দেখেই তাকে আমার ভীষণ ভালো লেগে গেছে। আমি ওই শাহজাদিকে বিয়ে করতে চাই। তুমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাও’।

ব্যবসায়ীর স্ত্রী মানে তার মা একথা শুনে কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কোনোমতে সে ইব্রাহিমকে বললো: ‘এইসব চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলেই ভালো। তুই একজন সামান্য ব্যবসায়ীর ছেলে,আর ও হলো রাজকন্যা। বাদশাহর কাছে তুই তার একজন চাকর বাকরেরও যোগ্য না। তোর কাছে বাদশাহ তার মেয়েকে বিয়ে দেবে কী কারণে’?

বাদশাহ তার কন্যাকে কেন ইব্রাহিমের কাছে বিয়ে দেবে-এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না ইব্রাহিম। সে চুপ করে বসে রইলো। এভাবে কিছু সময় কেটে যাবার পর ইব্রাহিমের বাবা ব্যবসায়ী বাসায় ফিরে এলো। কিছুক্ষণ পর সুযোগ বুঝে ইব্রাহিমের মা তার স্বামী ব্যবসায়ীকে বললো: ‘শুনেছো! তোমার ছেলে তো বাদশার মেয়ের প্রেমে পড়েছে। আমাকে বলেছে আমি যেন বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে রাজপ্রাসাদে যাই’। বৌ-য়ের কথা শুনে ব্যবসায়ী হেসে দিয়ে বললো: ‘বাদশার কানে এসব কথা গেলে বিয়ে না শুধু একেবারে বংশসুদ্ধ আমাদের সবাইকে এই দেশ ছাড়া করবে’।

ইব্রাহিম যখন দেখলো তার কথার কোনো গুরুত্বই দিলো না কেউ-না মা, না বাবা, তখন তার মাথায় আগুন ধরে গেল, নাক-মুখ-কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো তার। নিরূপায় হয়ে মাথার ভেতর সেই উদ্বেগের কুয়াশা নিয়েই গেল মক্তবে। কিন্তু পড়ায় তার কোনো মন নেই। সারাক্ষণ সে ভাবতে লাগলো শাহজাদির কথা। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়েই এখন শাহজাদির বসবাস। এভাবে কেটে গেল বহুকাল। ব্যবসায়ীরও বয়স হয়ে গেল এবং হঠাৎ একদিন মারা গেল। এতোদিন ইব্রাহিমের টেনশন ছিল শুধু শাহজাদির জন্য, এবার যোগ হলো বাবার অনুপস্থিতি। নাওয়া-খাওয়া কিছুই যেন তার ভালো লাগছে না এখন। ভবঘুরে অবস্থা তার। সকালে বের হয়। অলিগলি,পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার ঘুরে সন্ধ্যার সময় ফিরে আসে বাসায়। এখন তো আর ব্যবসায়ী বাবা নেই,সংসার তো চালাতে হবে। মা যতই ইব্রাহিমকে বোঝায়,কে শোনে কার কথা! ইব্রাহিমের এক কান দিয়ে ঢোকে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে যায়।

অবশেষে মা তার ভাই মানে ইব্রাহিমের মামাদের ডেকে এনে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। মামারা যতই বুঝালো তাতে ইব্রাহিমের কান হলো টানেলের মতো। একদিয়ে ঢুকলো আর অপরদিক দিয়ে বের হয়ে গেল। মামারা বললো: ‘বাদশার মেয়ে ছাড়া আর যে-কোনো মেয়ের কথা বলো,আমরা তোমার জন্য তাকে নিয়ে আসবো। কিন্তু শাহজাদির কথা বাদ দাও’! ইব্রাহিম বললো: ‘হয় শাহজাদি,নৈলে বিয়েই করবো না’।

মামারা তাদের বোনকে বললো: ‘লাভ নেই। ওকে ওর মতো থাকতে দাও! কিছুদিন গেলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখা যাবে’।

এভাবে দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাস গেল। ইব্রাহিমের অবস্থার কোনোরকম উন্নতি তো হলোই না বরং আরও খারাপের দিকে গেল।

মামারা এবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এভাবে চলতে থাকলে তো ভাগিনা মরেই যাবে। সবাই মিলে ভাবলো কী করা যায়। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো ইব্রাহিমকে কিছু টাকা পয়সা দেবে,যাতে কাজকর্ম করে। কাজে একবার মন লেগে গেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মামারা ইব্রাহিমকে কাছে ডেকে নিয়ে বললো: ‘দেখো! আমরা সাধারণ মানুষ! আমাদেরকে তো বাদশা তার প্রাসাদেই ঢুকতে দেবে না, তার কানে বিয়ের কথা তোলা তো দূরের কথা। তারচে বরং তুমি এক কাজ করো। এই টাকাগুলো নাও! এক শ তুমান। কাজকর্ম,ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করো’। ইব্রাহিম কোনো কথাই বলল না। মামারাও চলে গেল। পরদিন সকালে কী হলো-সে কথা শুনবো পরবর্তী পর্বে। (চলবে)

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৬/টি-৯৯.১/অ-১০৩