সুরা হিজরের প্রাথমিক পরিচিতিসহ কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আসমানি সুরার ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তা'র পর্ব পরিবেশন করছি । পবিত্র কুরআনের ১৫তম সুরা হল সুরা হিজর। মক্কায় নাজিল হওয়া এই সুরায় রয়েছে ৯৯ আয়াত এবং ৬ টি রুকু।
সালেহ নবীর জাতিকে বলা হত হিজরের অধিবাসী। তাই এ সুরার নামকরণ হয়েছে হিজর।
এ সূরার শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হল : কুরআনের সত্যতা ও নির্ভুলতা, মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় থাকা, আকাশের শিল্প কৌশল, হযরত আদম (আ.)-এর ঘটনা, জাহান্নামের স্তর-বিন্যাস, বেহেশতবাসীদের বৈশিষ্ট্য, হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অতিথি, লূত সম্প্রদায়ের ঘটনা, শোয়াইব (আ.)-এর জাতির ঘটনা, সালেহ (আ.)-এর জাতির ঘটনা, ধনসম্পদের গুরুত্বহীনতা, মুমিনদের জন্য সব অবস্থায় আল্লাহই যথেষ্ট হওয়া ইত্যাদি।
এ সুরায় বিশ্বনবী (সা.) ও পবিত্র কুরআনের প্রতি কাফিরদের কিছু অভিযোগের কথা ইশারা করা হয়েছে। তারা নিজেরা কুসংস্কারের পূজারী হওয়া সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব মহানবী (সা.)-কে বলত পাগল ও কুরআনকে পাগলের প্রলাপের বই বলে অভিহিত করত! তাই এ আয়াতে মহানবী (সা.)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন মহান আল্লাহ এবং তিনি তাঁকে শত্রুদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ধৈর্যশীল ও দৃঢ়চেতা থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
সুরা হিজরে সৃষ্টিকুলের উৎসমূল ও বিশ্ব-জগতের নানা রহস্য সম্পর্কে গভীর ভাবনার মাধ্যমে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আনার বার্তা রয়েছে। এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব, পরকাল, পাপীদের শাস্তি, আদম সৃষ্টির কাহিনী ও শয়তানের বিদ্রোহ এবং অতীতের কয়েকটি জাতির কাহিনীও স্থান পেয়েছে এই সুরায়।
সুরা হিজরের প্রথম আয়াতে এসেছে: ‘আলিফ-লা-ম-রা; এগুলো পরিপূর্ণ গ্রন্থ ও সুস্পষ্ট কোরআনের আয়াত। কোনো এক সময় নিজেদের কর্মফল দেখতে পেয়ে কাফেররা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, কি চমৎকার হত, যদি তারা মুসলমান হত। আপনি ছেড়ে দিন তাদেরকে, খেয়ে নিক এবং ভোগ করে নিক এবং আশার ছলনায় তারা উদাসীন হয়ে থাকুক। খুব শিগগিরই তারা জেনে নেবে।’
এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন একজন বার্তা প্রচারক বলতে থাকবেন একটি বিশেষ বার্তা যা সবাই শুনতে পাবে। ওই বার্তায় তিনি ঘোষণা করবে, ‘ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া কেউই বেহেশতে প্রবেশ করবে না। এ সময় মুসলমান ছাড়া অন্যরা বলতে থাকবে: হায়! আমরা যদি মুসলমান হতাম!’
পরবর্তী আয়াতে কাফিরদেরকে পাশবিক ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকতে দেয়ার পরামর্শের কথা এসেছে কঠোর ভাষায়। তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে ভাবলেও মৃত্যুর সময় ও কিয়ামতের দিন ঠিকই বুঝতে পারবে যে তারা কতই না হতভাগ্য! তবে মানুষের জীবনে অযৌক্তিক কল্পনা-বিলাসের বিপরীতে সুধারণা ও যুক্তি-ভিত্তিক আশার গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আশা হচ্ছে আমার উম্মতের জন্য রহমত। যদি আশার আলো না থাকতো তাহলে কোনো মা তার শিশুকে দুধ পান করাতো না ও কোনো কৃষকই লাগাত না গাছের চারা।’
সুরা হিজরের নয় নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘আমি নিজেই এ উপদেশ গ্রন্থ নাজিল করেছি এবং আমি নিজেই সুনিশ্চিতভাবে এর সংরক্ষণ করব।’
কুরআন এমন এক সূর্য যা কখনও অস্ত যাবে না ও এর আলো থাকবে সদা-প্রজ্জ্বোল। কারণ, মহান আল্লাহই এর সংরক্ষক। সারা বিশ্বের সবাই সর্বশক্তি দিয়েও বিকৃত করতে পারবে না কুরআনকে। কুরআনের সুরা বা আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লিখে রাখা হত। ওহি লেখকদের সংখ্যা ছিল ৪৩। আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)সহ চার খলিফা ছিলেন ওহি লেখকদের মধ্যে প্রখ্যাত। সাহাবি জাইদ বিন সাবিতও ছিলেন বিখ্যাত ওহি লেখক। কুরআনে বিন্দুমাত্র বিকৃতি ঘটেনি বলে মনে করেন শিয়া ও সুন্নি আলেমরা। তারা বলেন, সেই আদি কুরআন ও বর্তমান কুরআনের মধ্যে কোনো পার্থক্য ঘটেনি। তাই কুরআন আজও সবাইকে দেখিয়ে দেয় মুক্তির পথ। বিজ্ঞানের যতই উন্নতি ঘটছে কুরআনের বক্তব্যগুলোর সত্যতা ততই বেশি স্পষ্ট হচ্ছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক সূক্ষ্ম দিক ফুটে উঠছে জ্ঞানীদের কাছে। ফলে ব্যর্থ হচ্ছে কুরআন ও ইসলামের শত্রুদের নানা ষড়যন্ত্র। কুরআনে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ জীবনের সব দিকের সৌভাগ্যের বিধান ও দিক-নির্দেশনা রয়েছে। আলী (আ.) বলেছেন, কুরআন সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী ও এর যুক্তিগুলো কখনও ম্লান হবে না।
সুরা হিজরের পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে সৃষ্টিকুল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। সুদৃশ্য আকাশ ও গ্রহ-নক্ষত্র মহান আল্লাহর নিদর্শন। এরপর ভূপৃষ্ঠের নানা বরকত ও নেয়ামত সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন:
'আমি ভু-পৃষ্ঠকে বিস্তৃত করেছি এবং তার উপর পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্যে তাতে জীবিকার উপকরণ সৃষ্টি করছি এবং তাদের জন্যেও যাদের রিজিকদাতা তোমরা নও।'
ভূপৃষ্ঠ যদি সমতল ও প্রশস্ত না হত তাহলে এতে চাষাবাদ করাসহ অন্য অনেক কাজ করা সম্ভব হত না। অন্যদিকে পাহাড়গুলো পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল করে রেখেছে। প্রবল ঝড়কে বাধা দেয় পাহাড়গুলো ও নিয়ন্ত্রণ করে বায়ু-প্রবাহকে। তাই পাহাড় না থাকলে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ত। এ ছাড়াও পাহাড়গুলো বরফ ও ঝর্ণার উপযুক্ত সংরক্ষণাগার।
এরপর সুরা হিজরে মানবজীবনে ও জীবজগতে গাছপালার উপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে যার অর্থ, উদ্ভিদে ফল ও পাতাসহ সব কিছুই দরকার মত দেয়া হয়েছে। ফলে গাছপালারও নানা দিক আল্লাহর মহিমার নিদর্শন। এরপরের আয়াতে মানুষসহ সব জীবের জন্য জরুরি নানা উপকরণ দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে, এদের রিজিক আল্লাহই দেন যা দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সুরা হিজরের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: 'আমার কাছে প্রত্যেক বস্তুর ভান্ডার রয়েছে। আমি কেবল নির্দিষ্ট পরিমানেই তা নাজিল করি।'
মানুষকে যদি সব কিছুই অঢেল পরিমাণে দেয়া হত তাহলে মানুষ হয়ে পড়ত অলস, অকর্মণ্য ও নৈরাজ্য-প্রিয়। তাই হালাল রিজিকের জন্য সঠিক পথে পরিশ্রমী বা কষ্ট-সহিষ্ণু হওয়া মানুষের জন্য জরুরি। #