ইরানি গল্প ও রূপকথা: ‘চগুন দুজ’-২
আমরা দেখেছি ব্যবসায়ীর ছেলে শাহজাদিকে দেখে কীভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তার মামারা এসে তাকে বুঝালো যে তারা সাধারণ মানুষ,রাজ দরবারে যাওয়াই দুষ্কর,বিয়ের প্রস্তাব দেয়া তো দূরেরই কথা। তাকে বললো: ‘বরং এক কাজ করো। এই টাকাগুলো নাও! এক শ তুমান। কাজকর্ম,ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করো’। ইব্রাহিম কোনো কথাই বলল না। মামারাও চলে গেল। পরদিন সকালে কী হলো-সে কথা শুনবো আজকের আসরে।
ইব্রাহিমের হাতে এক শ তুমান ধরিয়ে দিয়ে মামারা চলে গেল। রাত পেরিয়ে সকাল হলো। ইব্রাহিম ওই এক শ তুমান পকেটে নিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছলো এক চৌরাস্তার মোড়ে। সেখানে গিয়ে দেখলো মানুষেরা জটলা পাকিয়ে আছে। ভীষণ ভীড়-বানরের খেলা দেখালে যেমন মানুষেরা ভীড় জমায় ঠিক তেমনি। ইব্রাহিম কোনোরকমে ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো এক লোক বৃত্তের মাঝখানে একটা বস্তার ভেতরে কী যেন ঢুকিয়ে লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছে-ভোজবাজি যাকে বলে। বস্তাটির মুখ বাঁধা। ভেতরে কি এক প্রাণী যেন আছে। ওই প্রাণীটা নড়ে চড়ে উঠছে মাঝে মাঝে। ভীড়ের ভেতেরের একজনকে জিজ্ঞেস করলো সে: বস্তার ভেতরে কী?
লোকটি বললো: একটা অজগর সাপ।
ইব্রাহিম খানিকটা কৌতূহলী হয়ে উঠলো। বস্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাপের নড়াচড়া দেখলো এবং এক সময় পা বাড়ালো জটলার বাইরে। পারলো না। কারণ যেই পা বাড়ালো অমনি কে যেন তাকে নাম ধরে ডাকলো। অবাক হলো ইব্রাহিম। এই অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের ভীড়ে কে তাকে নাম ধরে ডাকছে! মনে মনে ভাবলো শ্রুতি বিভ্রাট। ভেবে আবারও পা বাড়ালো। কিন্তু এবারও একইভাবে তাকে কেউ যেন ডাকলো। কান খাড়া করে শুনলো সে। ভ্র কুঁচকে এদিক ওদিক তাকালো। কেউই তারদিকে ফিরে তাকালো না। এবার নিজেই সে সবাইকে জিজ্ঞেস করলো: কে ডেকেছো আমাকে? কোনো কাজ থাকলে বলো! কিন্তু কেউ কোনো জবাব দিলো না। এবার নিশ্চিন্তে ইব্রাহিম রওনা হতে চাইলো। তখনই বস্তার ভেতরের প্রাণীটা বলে উঠলো: ‘আমাকে এই বস্তা থেকে উদ্ধার করো ইব্রাহিম’!
ইব্রাহিম তো অবাক! বস্তার ভেতর থেকে তাকে ডাকছে সাপ! উদ্ধার করতে হবে তাকে! ইব্রাহিম সাপের বস্তার মালিক মানে সাপুড়ের কাছে গিয়ে বললো: ওই বস্তাসহ সাপের দাম কতো?
সাপুড়ে বললো: এক শ তুমান!
ইব্রাহিম এক শ তুমান দিয়ে সাপের বস্তাটা কিনে তাড়াতাড়ি মুখ খুলে দিলো এবং সাপ বস্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। বিরাট অজগর সাপ। ড্রাগনের মতো পাখাওয়ালা অজগর দেখে ভীড় জমানো লোকজন ভয়ে চীৎকার চেঁচামেচি করতে করতে কেটে পড়লো যে যার মতো। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে গেল জটলা।
জটলা ফাঁকা হয়ে যাবার পর অজগর সাপ ইব্রাহিমকে বললো: ‘আমাকে কোলে নাও’!
ইব্রাহিম বিস্ময়ের সাথে বললো: কী..!
অজগর বললো: আমাকে কোলে তুলে নাও!
অগত্যা ইব্রাহিম অজগরকে কোলে নেয়ার জন্য তার কোমরে হাত দিতেই অজগর হয়ে গেল সুন্দর এক কবুতর। ইব্রাহিমের কাঁধে বসে এবার কবুতর বললো: আমাকে নিয়ে চলো বাসায়।
ইব্রাহিম কবুতররূপী অজগর সাপ নিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। পেছনে পেছনে ছুটছে তার কৌতূহলী জনতার মিছিল।
ঘরে ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করলো: কী রে কোথায় ছিলি! কী করেছিস সারাদিন।
ছেলে বললো: সারাদিন ঘুরে ঘুরে একটা অজগর পেলাম। কিনে নিয়ে এলাম।
মা কপাল কুঁচকে বললো: কী বললি..!
ইব্রাহিম বললো: একটা অজগর কিনেছি মা! এই দেখো!
বলেই সে কবুতরটাকে ছেড়ে দিলো মাটিতে আর কবুতর অমনি অজগরে পরিণত হয়ে গেল। অজগর নড়াচড়া করে উঠতেই মা ভয় পেয়ে গেল। বাসা ছেড়ে দৌড়ে ছুটে গেল ভাইদের কাছে। ভাইয়েরা বোনের অবস্থা দেখে জানতে চাইলো কী হয়েছে। বোন সব কথা খুলে বললো। ভাগিনার পাগলামির কথা শুনে মামারা বলাবলি করতে লাগলো:
‘টাকা দিলাম কাজ কারবার করার জন্য আর সে কিনা টাকা দিয়ে কিনে এনেছে সাপ! থাপড়িয়ে সাপ খাওয়াবো এবার’।
ভাগিনার উপরের রাগ আপাতত নিজেদের গালে আর মাথায় থাপপড় দিয়ে কমানোর চেষ্টা করলো মামারা। বোনের আবদার রক্ষা করা আর ভাগিনার কেনা সাপ দেখার জন্য মামারা দ্রুত চলে গেল বোনের বাড়ি। গা ছমছম করা উত্তেজনা, ভয় আর রাগ নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মামারা দেখলো তাদের স্বনামধন্য ভাগিনা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে উঠোনের এক কোণে। আর বিরাট ড্রাগনের মতো পাখাওয়ালা অজগর সাপ উঠোনে বৃত্ত আর বক্ররেখা এঁকে বেড়াচ্ছে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল মামারা। সবার নজর সাপের দিকে। সামনে এগুতে সাহস করছে না কেউ। গেইটে দাঁড়িয়ে রাগ ঝাড়ার চেষ্টা করলো ভাগিনার ওপর:
‘তোর কি আক্কেল বুদ্ধি বলে কিছু নেই? টাকা দিয়ে কেউ সাপ কেনে? ওই সাপ একবার নিশ্বাস ছাড়লে তুই পুড়ে ছাই হয়ে যাবি। সময় থাকতে ওই সাপ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। মরুভূমি বা বাগান টাগান কোথাও নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আয়’।
মামাদের মূল্যবান উপদেশ বাণী একেবারেই মূল্যহীন মনে হলো ইব্রাহিমের কাছে। তার কানেই যেন ঢুকলো না কথাগুলো। মামারা এবার হাল ছেড়ে দিলো। কী করা যায় ভাবতে লাগলো। অবশেষে তারা ভাগিনাকে আবারও এক শ তুমান দিয়ে বললো:
‘এই এক শ তুমান দিলাম আবারও। পাগলামি ছেড়ে কাজকাম কিছু একটা কর। এভাবে দিন যাবে না। তোর বাবাও নেই। মা একা কী করে সংসার চালাবে’।
ইব্রাহিম আজও এক শ তুমান রাখলো মামাদের হাত থেকে। টাকা দিয়ে মামারা চলে গেল। অজগর এবার ইব্রাহিমকে বললো:
‘কাল বাজারের অমুক গলিতে যাবে। দেখবে সেখানে এক লোকের কাছে হলুদ রঙের একটা কুকুরের বাচ্চা আছে। ওই বাচ্চাটাকে কিনে নিয়ে আসবে’।
ইব্রাহিম অজগরের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো। পরদিন সকালবেলা ইব্রাহিম সেই গলিতে গিয়ে দেখলো সত্যি সত্যি একটা হলুদ কুকুরের বাচ্চাকে ঘিরে মানুষের ভীড়। কুকুরের বাচ্চার গলায় লাগানো শেকল এক লোকের হাতে। ইব্রাহিম লোকটার কাছে গিয়ে কানে কানে জিজ্ঞেস করলো: হলুদ কুকুরের বাচ্চার দাম কত?
শেকলে একটা টান মেরে লোকটা বললো: এক শ তুমান।
ইব্রাহিম মামাদের দেওয়া ভবিষ্যত নির্মাণের স্বপ্নময় এক শ তুমান দিয়ে ওই কুকুরের বাচ্চাটাকে কিনে নিল। ইব্রাহিমের হাতে কুকুরের বাচ্চার গলায় লাগানো শেকল। কুকুরের বাচ্চা যাচ্ছে সামনে সামনে আর ইব্রাহিম পেছনে পেছনে। দু’জনই এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে।*(চলবে)
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৭/টি-৯৯.২/অ-১০৪