ইরানি গল্প ও রূপকথা: ‘চগুন দুজ’-৪
গত পর্বে আমরা দেখেছি সাপ এবং কুকুরের বাচ্চা নিয়ে ইব্রাহিম পথে পা রাখতেই সাপ বলেছিল তিন দরবেশের সঙ্গে দেখা হবে আজ। সাপ লাঠিতে পরিণত হয়েছিল। প্রথম দরবেশ তার হাতের আংটি খুলে ইব্রাহিমকে দিয়ে বলেছিলো: ‘লাঠিটা আমাকে দাও আর বিনিময়ে এই আংটিটা তুমি নাও’! ইব্রাহিম বলেছিলো: ‘আমার বৌও নাই,মেয়েও নাই। এই আংটি দিয়ে কী করবো’। তারই ধারাবাহিকতায় শুরু করা যাক আজকের পর্ব।
আংটির ব্যাপারে রইব্রাহিমের অনাগ্রহ দেখে দরবেশ বললো:
‘এটা সোলায়মান নবির আংটি। আঙুলে পরে একটু ঘষলেই তোমার সেবায় হাজির হয়ে যাবে শক্তিশালী জিনেরা। তাদেরকে তুমি যা করতে বলবে তাই করবে তারা। যে-সে আংটি নয় এটি’।
ইব্রাহিম আংটিটা নিলো এবং লাঠিটা দিয়ে দিলো দরবেশকে। সাত কদম না যেতেই ইব্রাহিম বলে উঠলো: ‘চগুন দুজ! দরবেশের মাথায় আঘাত করো’।
সঙ্গে সঙ্গে লাঠিটা তলোয়ারে পরিণত হয়ে দরবেশের ঘাড়ে আঘাত করে আবার লাঠিতে পরিণত হয়ে ইব্রাহিমের হাতে চলে এল।
ইব্রাহিম অবাক হয়ে পা বাড়ালো সামনের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা হলো দ্বিতীয় দরবেশের সাথে। এই দরবেশও ইব্রাহিমের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললো। কুশল বিনিময়ের ফাঁকে দরবেশের চোখ পড়লো লাঠির উপর। দরবেশ এবার লাঠিটা কিনতে চাইলো। কিন্তু ইব্রাহিম বিক্রি করবেনা বলে দিলো। অনেক পীড়াপীড়ির পর ইব্রাহিম রাজি হলো। দরবেশ ছোট্ট একটা ব্যাগ দিলো ইব্রাহিমকে। ইব্রাহিম বললো: ‘এটা কী! আমি কী করবো ব্যাগ দিয়ে’।
দরবেশ বললো: ‘এটা নবী সোলায়মানের ঝোলা। যখনই কোনো খাবার খেতে চাইবে ঝোলার ভেতর বিসমিল্লাহ পড়ে হাত দিলেই খাবার বেরিয়ে আসবে’।
ইব্রাহিম দরবেশকে বিদায় দিলো। সাত কদম না যেতেই বললো: ‘চগুন দুজ! দরবেশের মাথায় আঘাত করো’।
বলতেই প্রথম দরবেশের পরিণতি হলো এরও। ইব্রাহিম বেশ খুশি এখন। সবই তো হলো। এরকম ভাবতে ভাবতে পথ চলতে চলতেই পড়লো তৃতীয় দরবেশের সামনে। এই দরবেশও লাঠিটা নিতে চাইলো। বিনিময়ে সে দিলো বড় একটি পেরেক। ইব্রাহিম বললো: ‘পেরেক দিয়ে কী করবো আমি। দেখছো না,আমি পায়ে হেঁটে যাচ্ছি’!
দরবেশ বললো: ‘এটা সোলায়মান নবীর পেরেক। এর বৈশিষ্ট্য হলো মাটিতে পুঁতলেই প্রাসাদ তৈরি হয়ে যাবে’।
ইব্রাহিম পেরেকটা নিলো এবং খুশিতে দরবেশকে চুম্বন করলো। দরবেশ পা বাড়াতেই ইব্রাহিম সেই বাক্যটি উচ্চারণ করলো: ‘চগুন দুজ! দরবেশের মাথায় আঘাত করো’।
ব্যস দরবেশ মারা গেল আর লাঠিটা চলে এলো ইব্রাহিমের হাতে। ইব্রাহিম পা বাড়ালো সামনের দিকে,অজানা গন্তব্যে। যেতে যেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। দূরের কালো পাহাড়গুলোকে মনে হয় তুলি দিয়ে ক্যানভাসে আঁকা। উপরে ধূসর মেঘের গায়ে লেপটে আছে সূর্যের বিদায়ের লালিমা। ইব্রাহিম সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পৌঁছে গেলো জনমানবশূন্য এক মরুর মতো এলাকায়।
বলছিলাম জনমানবশূন্য এক মরুতে গিয়ে পৌঁছলো ইব্রাহিম। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে বসতে চাইলো মাটিতে। লাঠিটা মাটিতে রাখতেই অজগরে পরিণত হয়ে বললো: ‘রাতটা এখানে কাটিয়ে দেয়াই ভালো হবে’।
ইব্রাহিম বললো: ‘ঠিক আছে’।
খাবারের আয়োজন হলো,শোবারও। শুতে যাচ্ছিল ইব্রাহিম এমন সময় অজগর বললো: ‘তুমি কি জানো ওই বেড়াল এবং কুকুরের বাচ্চা আসলে কে’?
ইব্রাহিম বললো: ‘না’।
অজগর বললো: ‘ওরা আসলে পরী। দুজনই এখন তাদের মতো বিছানায় নিজেদের পরিচ্ছদের ভেতর শুতে গেছে’।
এই বলে অজগর তাদেরকে বেরিয়ে আসতে বললো। ওরা দুজন দেহরক্ষীর মতো এসে দাঁড়িয়ে গেল ইব্রাহিমের দুই পাশে। তাদের গায়ে লাল চামড়ার ইউনিফর্ম। হাতে তলোয়ার। বুকে হাত রেখে সম্মান জানালো ইব্রাহিমকে। অজগর এবার পরিণত হলো সুন্দরী এক মেয়েতে। অসম্ভব সুন্দরী।
ইব্রাহিমকে সে বললো: ‘আমি ওই জিনের স্ত্রী যাকে নিয়ন্ত্রণের আংটি এখন তোমার হাতে। সে আমাকে যাদু করেছিল। তোমার হাতে আংটি চলে আসার ফলে ওই যাদু এখন কেটে গেছে। আমি এখন মুক্ত। এখন আমি আমার নিজের মতো জীবন যাপন করবো’।
এই বলে পরীকন্যা তার মাথার একটি চুল ছিঁড়ে ইব্রাহিমের হাতে দিয়ে বললো: ‘যখনই কোনো বিপদে পড়বে এই চুলে একটু আগুন লাগাবে। আমি হাজির হয়ে যাবো’।
এই বলেই পরীকন্যা একটা ঘূর্ণি দিয়ে কবুতরে পরিণত হলো এবং উড়ে চলে গেল শূন্যে নিজের গন্তব্যে।
পরীকন্যা চলে যাবার পর ইব্রাহিমের একাকিত্ব বোধ হলো। সোলায়মানি আংটিটা আঙুলে পরে ঘষলো। অমনি পাঁচ পাঁচটি বিশালদেহী দৈত্য মানে জিন এসে হাজির হয়ে গেল ইব্রাহিমের খেদমতে। সবচেয়ে দীর্ঘদেহী যে তাকে ইব্রাহিম বললো: ‘অমুক বাদশার প্রাসাদে গিয়ে শাহজাদিকে সসম্মানে নিয়ে আসো আমার কাছে। সাবধান! শাহজাদির যেন কোনোরকম অসুবিধা বা ক্ষতি না হয়’।
ইব্রাহিমকে কুর্নিশ করে বড় দৈত্য বাকি চারজনকে নিয়ে একটা ঘূর্ণিপাক কেটে শোঁ করে হাওয়া হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে শহরে গিয়ে পুরো প্রাসাদটিকে মাটি থেকে গাছ তোলার মতো তুলে নিয়ে রেখে দিলো ইব্রাহিমের পাশে। ইব্রাহিম এই দৃশ্য দেখে নিজেই অবাক বনে গেল। সবাইকে ছুটি দিয়ে সে গেল প্রাসাদের ভেতর। গিয়ে দেখে শাহজাদি বিশ্রাম নিচ্ছে। তার মাথার পাশে একটি ড্রিম লাইট আরেকটি পায়ের কাছে। উৎফুল্লময় কৌতূহলে ইব্রাহিম এক দৃষ্টিতে তাকালো শাহজাদির দিকে। ফুলের মতো নিষ্পাপ ঘুমের ভেতর সেই মুখ হঠাৎ চোখ মেলে উঠে বসে বললো: ‘কে তুমি? আমার প্রাসাদে কী কাজ তোমার’?
ইব্রাহিম বললো: ‘ওঠো! চারদিকে তাকিয়ে দেখো,কোথায় তুমি’!
শাহজাদি ভীত সন্ত্রস্ত মনে এক পৃথিবীর বিস্ময় চোখে নিয়ে জানালা খুলে বাইরে তাকালো! বাইরে ফোয়ারা নেই,নেই ফুলের বাগান, যেদিকেই দুচোখ যায়,মরু আর ধূ ধূ প্রান্তর। শাহজাদি বুঝে উঠতে পারছিল না ব্যাপারটা কী! সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি কোনো জাদুর ঘোরে। নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলো সবই বাস্তব। ভয়ংকর সেই বাস্তবতা উপলব্ধির পর কী অবস্থা হলো শাহজাদির সেই গল্প শুনবো পরবর্তী আসরে।* (চলবে)
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৯/টি-১০০.২/অ-১০৬