আগস্ট ০১, ২০১৬ ১৪:৪৬ Asia/Dhaka
  • ইরানি গল্প ও রূপকথা: চগুনদুজ (পর্ব-৬)

আমরা ‘চগুন দুজ’ গল্পের গত পর্বে দেখেছি বুড়ির কথায় বাদশাহ একটি সিন্ধুক বানিয়ে দেয় এবং ওই বাক্স বিমানের মতো শোঁ করে উড়ে যায় শূন্যে। অনেক ঘুরে ফিরে অবশেষে তার নজরে এলো মরুভূমির মাঝখানে একটা প্রাসাদ। চারদিক বালি আর পাথুরে কণায় ভর্তি। বুড়ি চীৎকার করে বললো বুড়ি: ‘পেয়ে গেছি! লক্ষ্যবিন্দুতে বিদ্ধ হয়েছে চোখের তীর! এটা শাহজাদির প্রাসাদই হবে! হ্যাঁ, শাহজাদিরই প্রাসাদ। কোনো সন্দেহ নেই’। বুড়ির বাক্স বিমান প্রাসাদের খানিকটা দূরে ল্যান্ড করলো। তারপরের গল্প শোনার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আপনাদের।

বাক্স থেকে বেরিয়ে বুড়ি তার লাঠিতে ভর দিয়ে প্রাসাদের দিকে রাস্তা ধরলো। প্রাসাদে শাহজাদি একা। ইব্রাহিম গেছে শিকারে। তার বাড়ির প্রহরী হলুদ কুকুর আর কালো বেড়াল ঠিকঠাকমতোই পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তাদের নজর পড়লো বুড়ির ওপর। বুড়িকে দেখেই তারা তাদের প্রহরীর গুরুদায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে যেতে শুরু করে দিলো সরবে। এমনকি কুকুর তো তার হাত-পায়ের খঞ্জরই বসিয়ে দিতে চাচ্ছিল বুড়ির গায়। কুকুরের স্বাভাবিক দায়িত্বপূর্ণ আচরণের অস্বাভাবিক শব্দ শাহজাদির কানে যেতেই জানালা খুলে গেল। বাইরে তাকাতেই শাহজাদি দেখলো ‘বুড়ি এসেছে’। শাহজাদির চোখে মুখে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করেছে যেন।

প্রাসাদ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল গেইটে। বুড়িকে দেখেই খুশির হা-পিত্যেস বেড়ে গেল শাহজাদির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো:

‘তোমার তো এখানে আসতে পারার কথা না! এলে কী করে! কোন্‌ বালা-মুসিবত তোমাকে তাড়া করে নিয়ে এসেছে এই মরুতে’!

বলতে বলতে শাহজাদি বুড়িকে প্রাসাদের ভেতরে আসতে বললো। প্রহরীদের তো তখন আর কিছুই করার নেই। বুড়ির পেছনে পেছনে লেজ নাড়াতে নাড়াতে খানিকটা এসে কী যেন শুঁকে চিঁ চিঁ শব্দ করে ফিরে গেল কুকুর। আর বুড়ি হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি ভাঙলো প্রাসাদের। বেড়ালেরও কিছু করার ছিল না। শাহজাদির অতিথিকে কী করে বহিরাগত ভাববে তারা।

বুড়ি প্রাসাদে ঢুকে বসতেই শাহজাদির দিকে তাকিয়ে শুরু করে দিলো তার কাজ:

‘তোমার বাবা যখনই শুনেছে তুমিও নেই তোমার প্রাসাদও নেই,তখন থেকেই সে যে কী অবস্থা! না দেখলে বুঝানো কঠিন। বাদশার এক চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু আরেক চোখ দিয়ে খুন’।  

বুড়ি এমনভাবে বললো যে শাহজাদির মনের ভেতরে কথার একটা তালাবদ্ধ সিন্দুক তৈরি হয়ে গেল। শাহজাদির মাথাটা ধরে টেনে তার মাথায় ঠেকিয়ে রাখলো। অনেকক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করলো দুজনেই। কান্নার আঠা দুজনের মাথাকেই কিছুক্ষণ আটকে রাখলো। অশ্রুর আঠা শুকিয়ে যেতেই বুড়ি শাহজাদিকে শান্ত অথচ বিস্ময় মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করলো:

‘কী করে এসেছো এখানে, প্রাসাদ এলো কী করে’!

‘প্রাসাদ এলো কী করে’ এ প্রশ্নের জবাবে শাহজাদি বললো: ‘জানি না কোনো দৈত্য কিংবা পরীর কাজ ছিল কিনা! তবে এটুকু জানি! ইব্রাহিম নামে একটি ছেলে আমার প্রেমে পড়েছে এবং সে-ই আমাকে তার কাছে নিয়ে এসেছে’।

বুড়ি এবার তার অভিজ্ঞতার ট্রিটমেন্ট দিতে শুরু করলো। শাহজাদিকে বললো: ‘এক কাজ করবে। ইব্রাহিমকে প্রেমের সুরা দিয়ে তার মুখ থেকে বের করবে গোপন কথা-‘কী করে সে তোমাকে এখানে নিয়ে এলো প্রাসাদসুদ্ধ’। এই ছোট্ট অথচ মহান দায়িত্ব শাহজাদির মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বুড়ি গেল তার সিন্দুক বিমানের কাছে। দূরের পাহাড়গুলো তখন ধূসর ছায়ার মতো, উপরে সাদা মেঘে লেগেছে আলতার রং। পাখিরা ফিরে যেতে লাগলো নিজেদের বাসায় আর ইব্রাহিম ফিরলো তার প্রিয় প্রাসাদে। তার হাতে ঝুলছে শিকার করা হরিণ।

নিজ হাতে শিকার করা হরিণ। শাহজাদির সামনে মেলে ধরে ইব্রাহিম দেখালো তার বীরত্ব। কাবাব বানালো। খেলো দুজনেই মজা করে। স্পেশাল ডিনার,তবু শাহজাদি জানতে চাইলো না শিকারের গল্প। ইব্রাহিম নিজে নিজেই শোনাবার চেষ্টা করলো। তখনই ফিরে এলো বুড়ি। হরিণের মাংসের মজার কাবাবটা পুরোই হাড্ডি হয়ে গেল যেন। দন্ত-চোয়ালের কাজ বন্ধ হয়ে গেল ইব্রাহিমের। দৃষ্টি তার অচেনা বুড়ির ওপর থেকে শাহজাদির ওপর গিয়ে স্থির হয়ে গেল। আলতো করে জানতে চাইলো ইব্রাহিম: ‘কে এই বুড়ি! কেন এসেছে এখানে’!
শাহজাদি বললো: ‘এই বুড়ি মরুভূমিতে এসে বিপদে পড়ে গেছে। রাতটা বেচারি এখানে থাকতে চেয়েছে। আমি ‘না’ করতে পারি নি’।
ইব্রাহিম কিছুতেই রাজি হতো না। কিন্তু শাহজাদি যেহেতু থাকতে দিয়েছে, তার সম্মানে অগত্যা রাজি হয়ে গেল। বুড়িকে কাছে ডেকে বসালো এবং কাবাব খেতে দিয়ে বললো:

‘খাও! আমার শিকার করা হরিণের কাবাব’।

বুড়ি কাবাব খেল। তারপর তাকে তার কামরা দেখিয়ে দিয়ে শাহজাদি বললো: ‘যাও! তুমি এই রুমে ঘুমাও’!

বুড়ি বললো: ‘ভুলে যেও না কিন্তু...মনে আছে তো...’।

শাহজাদি বললো: ‘হ্যাঁ! মনে আছে,ভুলি নি’।

শাহজাদি দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে বিছানায় গেল। শিকারীকে শিকার করতে ফাঁদ পাতলো শাহজাদি। বললো: ‘তুমি তো অনেক বড় শিকারী।তোমার মতো এত বড়ো বীর পুরুষ আমি আর দেখি নি। হরিণ শিকারের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু পছন্দের মানুষকে কাছে পেতে একেবারে প্রাসাদসুদ্ধ তুলে আনা...! বাব্বাহ! আমি ধন্য’।

শাহজাদি আরও বললো: আমি এখানে আসার পর থেকেই ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করবো: কী করে তুমি আমাকে প্রাসাদসুদ্ধ নিয়ে এলে এখানে! এ যে অবিশ্বাস্য’!

ইব্রাহিম তার হাতটা শাহজাদির চোখের সামনে তুলে ধরে বললো: ‘এই যে আংটি টা দেখছো! সবই এই আংটির কারসাজি’।
এ কথা শুনে শাহজাদির কৌতূহল বেড়ে গেল। ইব্রাহিমের কাছ থেকে পুরো ঘটনা সে শুনলো। তারপর শাহজাদি বললো:

‘কই! দেখি তো আংটি টা একবার’।

তারপরের ঘটনা শুনবো পরবর্তী পর্বে। (চলবে)

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/১/টি-১০১.২