"নিশ্চয়ই খোদাভীরুরা বেহেশতের সবুজ বাগান ও নির্ঝরিনীগুলোতে থাকবে।"
সুরা হিজরের ২৬ থেকে ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর অনুপম সৃষ্টি মানুষের নানা রহস্য তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলছেন যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনুজ্জ্বল মাটি থেকে। এরপর তাদের জীবন দেয়া হয়েছে।
মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যা খায় সেইসবের একটা অংশ আসে উদ্ভিদ থেকে যা মাটিতেই জন্মে। কোনো কোনো আয়াত থেকে মনে হয় মানুষকে প্রাথমিক পর্যায়ে গঠন করা হয়েছিল মাটি থেকে। এরপর বীর্যের মাধ্যমে তাদের বংশ ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে মানুষের আসল সত্ত্বা হল আল্লাহর ফুঁকে দেয়া রুহ। আর এ কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব ও আল্লাহর প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবেই খোদার প্রতিনিধি অর্জন করতে পারে খোদায়ী কিছু গুণ। তাই আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা আদমকে সিজদা করলেও ইবলিস নিজেকে বড় মনে করে তা করা থেকে বিরত হয়। শয়তান প্রকৃত ও আন্তরিক-চিত্তের মু'মিনকে ধোঁকা দিতে পারে না। যারা বিভ্রান্ত হয়ে থাকে কেবল তারাই শয়তানের কুমন্ত্রণায় প্রভাবিত হয়ে তার অনুসারী হয়। সুরা হিজরের ৪৫ থেকে ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'নিশ্চয়ই খোদাভীরুরা বেহেশতের সবুজ বাগান ও নির্ঝরিনীগুলোতে থাকবে। তাদের বলা হবেঃ এগুলোতে নিরাপত্তা ও শান্তি সহকারে প্রবেশ কর। তাদের অন্তরে যে ক্রোধ বা গ্লানি কিংবা হিংসা ও জিঘাংসা ছিল, আমি তা দূর করে দেব। ফলে তারা ভাই ভাইয়ের মত সামনা-সামনি আসনে বসবে। সেখানে তাদের মোটেই ক্লান্তি ও কষ্ট হবে না এবং তারা সেখান থেকে বহিস্কৃত হবে না।'
অর্থাৎ বেহেশতের সুখ কেবলই বস্তুগত নয়। আধ্যাত্মিক তৃপ্তিও থাকবে সেখানে। বেহেশতে ঝর্ণা ও বাগান বলতে বিচিত্র ধরনের অফুরন্ত নেয়ামতকে বোঝানো হচ্ছে। নানা ধরনের ঝর্ণার যে বর্ণনা কুরআনে এসেছে হয়তো সেসব এ দুনিয়ার নানা ধরনের সৎ কাজেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে দেখা দেবে পরকালে। এই দুনিয়ায় বা পরকালে শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো নেয়ামত ভোগের কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই বেহেশতিদের প্রথমেই এই নেয়ামত দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। তাদের কোনো বিপদের ভয় নেই। সেখানে পীড়াদায়ক বা বাড়তি আনুষ্ঠানিকতার কোনো বালাই নেই। পার্থিব জীবনে শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের যে যন্ত্রণা তার কোনো রেশ নেই বেহেশতে। সেখানে নেই হিংসা, প্রতিহিংসা, শত্রুতা ইত্যাদি। এ ছাড়াও বেহেশতের অপার সুখ ও সৌভাগ্য কোনো একদিন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এমন দুঃশ্চিন্তারও কোনো অবকাশ নেই সেখানে।
অন্য কথায় বেহেশতে বস্তুগত নেয়ামতের পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, নিরাপত্তা, পবিত্রতা ও প্রফুল্লতার মত আত্মিক বা আধ্যাত্মিক নেয়ামতও থাকবে অফুরন্ত, পরিপূর্ণ ও ত্রুটিহীন মাত্রায়।
যখন সৎকর্মশীলরা তাদের কাজের পুরস্কার হিসেবে বেহেশতে এমন অফুরন্ত ও বিচিত্রময় নেয়ামতের অধিকারী হবে তখন সুখ ও সৌভাগ্যের এতসব প্রাচুর্য দেখে পাপীরা বলবে: হায় আমরা যদি এর ছিটেফোটাও পেতাম! তাই মহান আল্লাহ পরের আয়াতেই অশেষ করুণা-ভরা সুরে বিশ্বনবী (সা.)-কে সম্বোধন করে বলছেন, 'আপনি আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিন যে, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।'
এখানে মহান আল্লাহ পাপীদেরকেও নিজের বান্দা বা দাস বলে অভিহিত করেছেন। এর অর্থ তারাও যদি তওবা করে নিজেদের সংশোধন করে নেয় তাহলে ক্ষমা এবং বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামতের অধিকারী হবে। এখানে হয়তো এমন ইঙ্গিতও রয়েছে যে, মানুষ যদি এই পার্থিব জীবনেও সব সময় সৎ থাকে এবং হিংসা, প্রতিহিংসা, লোভ, ও শত্রুতার মত খারাপ স্বভাব দূর করে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, অন্যের উপকার করা ও ত্যাগের মত ভালো গুণগুলো অর্জন করতে পারে তাহলে তারা এই পৃথিবীকেও অনেকটা বেহেশতের মত শান্তিপূর্ণ ও নানা সুখের উপকরণে ভরা আবাসস্থলে পরিণত করতে পারবে।
এরপর সুরা হিজরে হযরত ইব্রাহিম ও লুত (আ.)'র ঘটনা এসেছে। একদল ফেরেশতা অজ্ঞাতপরিচয় মেহমানের বেশ ধরে এসে ইব্রাহিম (আ.)-কে সন্তান লাভের সুসংবাদ দেন এবং লুত নবীর জাতির ওপর খোদায়ী আজাব নাজিল হবে বলে এই দুই নবীকে জানান। আয়াতে ফেরেশতাদের সঙ্গে ইব্রাহিম (আ.) ও লুত (আ.)'র আলোচনা কথা বলা হয়েছে। লুত নবীর জাতিরা ছিল সমকামী। ফলে আল্লাহর শাস্তি তাদের ওপর নেমে আসে ও তারা ধ্বংস হয়ে যায় অন্যদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে।
এরপর হিজরের অধিবাসীদের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে এ সুরার ৮০ থেকে ৮৪ নম্বর আয়াতে। হিজরের অধিবাসীরা মহান আল্লাহর দেয়া প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে বিলাসী জীবন যাপন করত। মহান আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখানোর জন্য সালেহ নবীকে (আ.) পাঠান। কিন্তু তারা আল্লাহর প্রেরিত নবীদের নবী বলেই স্বীকার করতো না। ঐতিহাসিকদের মতে তাদের আবাসস্থলটি ছিল মদীনা থেকে সিরিয়া যাওয়ার একটি পথের পাশে। আজও সেই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
পার্বত্যময় এই শহরের তথা হিজরের অধিবাসীরা বিলাসিতার জন্য খুবই পরিশ্রম করত। পাহাড়ের ভেতরেই তারা তাদের বাসভবন নির্মাণ করত বলে তা খুবই নিরাপদ ও মজবুত ছিল। ঝড় ও বন্যায় তাদের কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু তাদের নৈতিক অধঃপতন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। বিলাসীতায় অভ্যস্ত ও সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে অহংকারি হওয়ায় তারা নবীদের দেখানো সুপথ বা মুক্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করত এবং এমনকি তাঁদের কথাই শুনতে চাইত না। ফলে তাদের ওপর নেমে আসে খোদায়ী শাস্তি। প্রচণ্ড বজ্রনিনাদে এই অহংকারি জাতির বাড়িঘরগুলো ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাদের লাশগুলো ছিটকে পড়ে থাকে মাটিতে। ফলে সুউচ্চ পর্বতের ভেতরে তৈরি-করা নিরাপদ ঘরও খোদাদ্রোহী এই জাতিকে রক্ষা করতে পারেনি এবং তাদের বিপুল সম্পদও কোনো কাজে আসেনি।
সুরা হিজরের শেষের দিকের আয়াতে এসেছে:
অতএব, হে নবী, আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না। বিদ্রুপকারীদের অনিষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষার জন্যে আমিই আপনার পক্ষ থেকে যথেষ্ট।(৯৪-৯৫)
মহানবী (সা.) তিন বছর ধরে গোপনে ইসলাম প্রচারের পর প্রকাশ্যেই মুশরিকদের কাছে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পান। কাফিরদের বিদ্রুপ শুনে তিনি যেন মনে কষ্ট না পান সে জন্য তাঁকে আল্লাহর তাসবিহ বা প্রশংসা করতে ও মহান আল্লাহর প্রতি সিজদা করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এইসব পদক্ষেপ একদিকে যেমন বাড়তি শক্তি যোগায় পাশাপাশি মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককেও দৃঢ়তর করে। বিপদাকীর্ণ খোদায়ী মিশনের জন্য কেবল আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা উচিত। কারণ, আল্লাহই এ ধরনের দায়িত্ব বাস্তবায়ন করাকে সফল করতে সক্ষম। সত্যের মোকাবিলায় মিথ্যার পক্ষের লোকেরা প্রতিরোধের পাশাপাশি সত্যকে উপহাসও করেছে যুগে যুগে। কিন্তু সত্যের অনুসারীরা মহান আল্লাহর প্রশংসা করা, তাঁর ইবাদত করা ও তাঁরই অসীম শক্তির ওপর ভরসা করার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চেয়েছে এবং মিথ্যার মোকাবেলায় রুখে দাঁড়িয়েছে।#