অক্টোবর ১৮, ২০১৬ ১৮:১৪ Asia/Dhaka

ভাইবোনেরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আসমানি সুরার ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তা'র পর্ব পরিবেশন করছি। আজও আমরা সুরা 'আসরা' বা বনি ইসরাইলের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরবো।

গত পর্বের আলোচনার ধারাবাহিকতায় মা-বাবার প্রতি সন্তানের দয়ার্দ্র আচরণ ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ সম্পর্কিত দুই আয়াতের ব্যাখ্যা শোনাবো সবার আগে।

সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, (২৩) তোমার প্রতিপালক নিশ্চিত বিধান দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করবে না বাবা-মায়ের সাথে সদাচার করবে; যদি তাঁদের মধ্যে একজন বা উভয়েই তোমার সামনে বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাঁদেরকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলবে না, আর তাঁদের ধমক দিয়ে বা তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিও না এবং তাঁদের সাথে সম্মানসূচক বা মমতাপূর্ণ কথা বলবে । (২৪) এবং তাঁদের সামনে বিনয়-নম্র হয়ে নিজের কাঁধ নত করে দেবে এবং তাঁদের জন্য এ প্রার্থনা করবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের উভয়ের ওপর করুণা কর, যেরূপে আমার শিশুকালে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’

ইসলামের দৃষ্টিতে তাওহীদ বা একত্ববাদ হচ্ছে সমস্ত ইতিবাচক, সৎ ও গঠনমূলক কাজের ভিত্তি। এর পাশাপাশি বাবা-মায়ের প্রতি সম্মান ও বিনম্রতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে দয়ার্দ্র আচরণের কথা বলা হয়েছে। বাবা-মা ও সন্তানদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং গভীর ভালবাসা সমাজকে সুদৃঢ় রাখার জন্য জরুরি। তাই মহান আল্লাহ সন্তানদের জন্য বাবা-মায়ের কষ্টের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। বাবা-মা যদি কাফিরও হয় তবুও তাদের সঙ্গে দয়ার্দ্র ও সম্মানজনক আচরণ করতে হবে বলে পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে তারা যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তবে তাদের সঙ্গে ক্ষুদ্রতম অপমানসূচক কথাও বলা যাবে না। তাফসিরে এসেছে, বাবা-মায়ের প্রতি চোখ তুলে দেখবে না, তাঁদের কণ্ঠস্বরের ওপরে নিজ কণ্ঠস্বর, তাঁদের হাতের ওপর নিজের হাত উঁচু করবে না, তাঁদের আগে পথ চলবে না, তাঁদের নাম ধরে ডাকবে না, তাঁদের অগ্রে বসবে না ও এমন কোন কাজ করবে না যাতে লোক তাঁদের গালমন্দ করে। যদি তাঁরা মুমিন হন, তবে তাঁদের মাগফেরাত বা মার্জনার জন্য এবং মুমিন না হলে, তাঁদের হেদায়েত ও ঈমানের জন্য দোয়া করবে। তাঁদের জন্য এ প্রার্থনা করবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের উভয়ের ওপর করুণা কর, যেরূপে আমার শিশুকালে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’

বলা হয় বাবা-মায়ের দিকে দয়ার্দ্র দৃষ্টিতে তাকানোও ইবাদত। এমনকি বাবা-মা সন্তানের ওপর জুলুম করলেও প্রতিশোধ নেয়া যাবে না ও অসম্মান করা যাবে না। বাবা-মা মানসিক ও শারীরিকভাবে যত বেশি দুর্বল হবে ততই তাদের বেশি যত্ন করা ও তাদের প্রতি বেশি সহৃদয় হওয়া জরুরি। কারণ, এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে আমরা যখন শিশু, দুর্বল ও অক্ষম ছিলাম তখন তারা আমাদের সন্তুষ্ট ও সযত্নে রাখার জন্য যে কোনো কষ্ট স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করতেন না।

একদিন এক বৃদ্ধ বাবা মহানবী (সা.)'র কাছে এসে বলেন যে, এক সময় আমি ছিলাম শক্তিশালী ও অর্থশালী। সে সময় আমি সন্তানকে সহায়তা করতাম। কিন্তু আজ আমার  এই সন্তান অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সাহায্য করছে না। দয়ার নবী (সা.) এ কথা শুনে কাঁদলেন ও বললেন: এমন কোনো পাথর ও কণা পাওয়া যাবে না যে এই কাহিনী শোনার পর নিজের কান্না ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। এরপর মহানবী (সা.) ওই সন্তানকে বললেন,  'তুমি ও তোমার সব সম্পদ তো তোমার বাবারই সম্পদ'।

এরপর সুরা আসরা বা বনি ইসরাইলে আত্মীয়-স্বজন, দরিদ্র ও নিঃস্ব এবং আটকে পড়া মুসাফির বা পথিকদের অধিকার আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া অপচয় না করার ও দান-খয়রাতের কথা এসেছে। এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষারও পরামর্শ দিয়েছেন মহান আল্লাহ।

সুরা বনি ইসরাইলের ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

'(২৯) এবং তোমার হাত দু’টিকে তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখ না  তথা দান করা বন্ধ কর না, আর তা সম্পূর্ণরূপে প্রসারিতও কর না তথা সীমাহীনভাবে দান কর না, নতুবা পরে তোমাকে নিন্দিত ও রিক্তহস্ত হয়ে বসে পড়তে হবে।

মহানবী (সা.) একদিন ঘরে থাকা অবস্থায় এক সাহায্য প্রার্থীর মুখোমুখি হলেন। দেয়ার মত কিছুই ছিল না। সাহায্যপ্রার্থী একটি জামা চাওয়ায় দয়ার নবী (সা.) তার একমাত্র জামাটি দান করে দেন। ফলে তিনি সেদিন মসজিদের যেতে পারেননি। এ অবস্থায় সুরা বনি ইসরাইলের এই আয়াত অর্থাৎ ২৯ নম্বর আয়াত নাজিল হয়।

সুরা বনি ইসরাইলের ৩২ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'(৩২) এবং ব্যভিচারের কাছেও যেও না, তা অবশ্যই অশ্লীল কর্ম এবং অতি নিকৃষ্ট পথ। (৩৩) যাকে হত্যা করা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, যথাযথ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা কর না। এবং যে অন্যায়ভাবে নিহত হয়, নিশ্চয়ই আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি; কিন্তু হত্যার ব্যাপারে তথা প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে, নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করা হবে। (৩৪) ইয়াতিম যতক্ষণ না বয়ঃপ্রাপ্ত হবে, উত্তমপন্থা ছাড়া তার সম্পদের নিকটবর্তী হয়ো না; এবং প্রতিশ্রুতি পালন কর, কারণ, প্রতিশ্রুতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হবে।'

মানুষের জীবনের মর্যাদা নানা ধর্মীয় বিধানসহ মানব-রচিত বিধানগুলোতেও গুরুত্ব পেয়েছে। তবে ইসলাম এক্ষেত্রে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। সুরা মায়িদায় বলা হয়েছে একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে গোটা মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য। কেউ যদি অন্যায়ভাবে নিহত হয় তাহলে তার অভিভাবকরা প্রতিশোধ নেয়ার তথা কাসাসের অধিকার রাখেন। তবে প্রতিশোধ হতে হবে সমানুপাতিক। এক্ষেত্রে নিহত পক্ষের অভিভাবকরা চাইলে ক্ষমাশীলও হতে পারেন। তারা যতক্ষণ প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবেন না ততক্ষণ খোদায়ী সাহায্য তাদের পক্ষে থাকবে।

বিভিন্ন কারণে ও দুর্ঘটনায় সমাজে অনেক শিশু ইয়াতিম হয়। সমাজের বিত্তবানদের উচিত এইসব ইয়াতিম শিশুদের সহায়তা দেয়া। তাই ইসলাম এর ওপর অসাধারণ গুরুত্ব দিয়েছে। ইয়াতিমের অধিকার লঙ্ঘন ও তাদের সম্পদে অন্যায্য হস্তক্ষেপের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে পবিত্র কুরআন। সুরা বনি ইসরাইলের ৩৪ নম্বর আয়াতের প্রথমে ইয়াতিমের সম্পদ রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এরপর বলা হয়েছে, তাদের সম্পদের কাছেও যাবে না। অর্থাৎ ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করা তো দূরের কথা বরং তার সম্পদের ব্যাপারে সম্মানজনক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। ইয়াতিমের সম্পদের কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে দূরে থাকলেও চলবে না। তাই বলা হয়েছে ইয়াতিমের সম্পদ সংরক্ষণের সর্বোত্তম পন্থা প্রয়োগের জন্য তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা যাবে বা তাদের সম্পদ অস্থায়ীভাবে দখল করা যাবে। কারণ, ইয়াতিম শিশুরা নিজ সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম নয়। অবশ্য ইয়াতিম যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হবে ও নিজের সম্পদ রক্ষার মত যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হবে কেবল তার আগ পর্যন্তই এই নির্দেশ প্রযোজ্য।#