নভেম্বর ০৭, ২০১৬ ১৭:০২ Asia/Dhaka

মিসেস ইউলি শৈশব থেকেই ভাবতেন যে, বিশ্বের যে শৃঙ্খলা রয়েছে তার একজন প্রণেতা রয়েছে। ইউলি তাঁকে বলতেন, 'আকাশগুলোর রাজা'। তিনি বড় হয়েছেন শিয়াঙ্গ শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তার মধ্যে এ প্রশ্ন জেগেছিল যে, মানুষ কোথা হতে এসেছে, কেন এসেছে এবং কী তাঁর দায়িত্ব? চীনের বিরাজিত পরিস্থিতির কারণে এবং এ সম্পর্কিত যথেষ্ট বই-পুস্তক না থাকায় তিনি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাননি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সে সময় আল্লাহ বা স্রস্টাকে বোঝানোর জন্য কোনো শব্দ আমার কাছে ছিল না।

এ সময় এক খ্রিস্টান বন্ধু স্রস্টা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করে। স্রস্টা সম্পর্কে এই বন্ধুর বক্তব্যের মধ্যে ইউলি তার শৈশবের কল্পিত 'আকাশগুলোর রাজা'র মিল খুঁজে পান। ফলে এ ধর্মের প্রতি তার মধ্যে আগ্রহ জন্মে। কিন্তু গির্জায় একটি প্রার্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে ভুলক্রমে একটি মসজিদের সামনে নামিয়ে দেয় এবং ইউলি বহু মুসল্লির সঙ্গে ঢুকে যান মসজিদে।

মিসেস ইউলি ওই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে:

"প্রথমে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। কিন্তু খুব দ্রুত সৌন্দর্যের অনুভূতি ছড়িয়ে গেল আমার মধ্যে। লম্বা ও সাদা পোশাক পরা মহিলা মুসল্লিদের সঙ্গ নিলাম। আমি জানতাম না যে, সেখানে আমাকে নামাজ পড়তে হবে। মসজিদে যা যা করতে হল তা আমাকে বেশ আনন্দই দিল। বিচিত্রময় আধ্যাত্মিক আনন্দ অনুভব করতে লাগলাম। মসজিদের আধ্যাত্মিক পরিবেশ আমাকে বেশ প্রভাবিত করল এবং খুব দ্রুত ঘনিষ্ঠতা অনুভব করলাম। মনটা যেন জুড়িয়ে গেল প্রশান্তিতে। সে রাত থেকেই গভীরভাবে ভাবতে লাগলাম ও স্রস্টা তথা আল্লাহকে বললাম: হে খোদা! তুমি যদি থেকে থাক, তাহলে দয়া করে তোমার নিদর্শনগুলো আমার জন্য স্পষ্ট কর যাতে তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি।"

চীনা নও-মুসলিম ইউলি আরো বলেন,

"সেদিন থেকে একটি বছর কেটে গেছে। আমার আত্মা তখনও সত্যকে খুঁজছে হন্য হয়ে। একদিন কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে সফরে বের হলাম। মাঝপথে রাত কাটাতে হল এক পরিচিত ব্যক্তির বাড়ীতে। সেই বাড়িতে আমি একটি বই পেলাম। বইটি ছিল চীনা ভাষায় অনূদিত একটি ধর্মীয় বই। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত গভীর আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়লাম। পরদিন ভোরে বাড়ীর মালিকের কাছ থেকে বইটি ধার চাইলাম। তিনি জানালেন, এ বইটি হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং এতে রয়েছে ইসলাম ধর্মের বিধান। এরপর তিনি মহান আল্লাহ ও ইসলামের নীতিমালা সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। কুরআন পড়ে আমি অত্যন্ত পুলকিত হলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে এই বইয়ের সর্বত্র যার কথা রয়েছে তিনি হলেন সেই প্রিয় অস্তিত্ব যাকে আমি বহু বছর ধরে খুঁজছিলাম। হৃদয়ের গভীর থেকে কথা বললাম আল্লাহর সঙ্গে এবং প্রার্থনা করলাম সুপথ ও তাঁকে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ। কুরআনে যা পড়লাম তাতে মনে হল আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেন এবং তিনি আমাকে সত্যের দিশা দেবেন বলে বাছাই করেছেন। আমি বুঝতে পারলাম আল্লাহ হচ্ছেন জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বাস্তবতা।"

ইউলি পবিত্র কুরআন পাঠের পর ও ইসলাম সম্পর্কে জানার পর মুসলমান হয়ে যান এবং নিজের জন্য সুমাইয়া নামটি বেছে নেন। হযরত সুমাইয়া (সালামুল্লাহি আলাইহা) ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। এই নামটি বেছে নেয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমার এক বন্ধু আমাকে ‘মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সা.)’ শীর্ষক ছায়াছবিটি দেখায়। নারী হওয়া সত্ত্বেও হযরত সুমাইয়ার সাহসিকতা ও প্রতিরোধের দৃশ্য যা এ ছায়াছবিতে তুলে ধরা হয়েছে তা আমার হৃদয়ে গেঁথে যায়। এই মহীয়সী নারী ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যে আল্লাহর রাসূল সেই সাক্ষ্য উচ্চারণ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। সুন্দর ও পবিত্র নাম মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ হওয়ায় আমি এই নামটি নিজের জন্য বেছে নিয়েছি। তাঁর সার্বক্ষণিক প্রতিরোধ আমার দুর্বল ও আবেগ-প্রবণ চিত্তকে এতটা সাহসী করে তুলেছিল যে, এতে আমি নিজেই এবং আমার পরিবারও বিস্মিত হয়েছে। কোনো সমালোচনাই আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পারেনি। বরং আমি প্রকাশেই সবাইকে জানিয়ে দেই যে আমি মুসলমান হয়েছি।"

চীনা নও-মুসলিম ইউলি আরো বলেছেন,

"আমি  ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলাম এবং এ ধর্ম সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চেয়েছি। আমি ইতিহাসে পড়েছি যে, চীনের জনগণকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য ইরানিরা অনেক কষ্ট করেছে। তাই একজন মহিলার সহায়তায় আমি ইরানের দূতাবাসে উপস্থিত হই। আমি ইনকিলাবে নুর বা আলোকোজ্জ্বল বিপ্লব বইটির কিছু অংশ পড়েছিলাম এবং ইরানের নেতা ইমাম খোমেনী (র.) সম্পর্কেও কিছু জানতে পেরেছিলাম। তাই আরো ভালোভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালন বা প্রকৃত মুসলমান হওয়ার উদ্দেশ্য আমি ইরান দূতাবাসে উপস্থিত হই। যখন আমার পরিবার বুঝতে পারল যে, আমি ইরানে যাব তখন সবাই বিরোধিতা করতে লাগল। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার চাপের মুখে বাবা অনুমতি দিলেন। ফলে ইরানে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হলাম। ফার্সিতে কথা বলতে শিখলাম। এই ফার্সি সাহিত্য আমার কাছে খুবই চমৎকার হলাম। সাদি, হাফিজ ও নাসির খসরুর মত কবিরা ফার্সি সাহিত্যের অতি উন্নত অবস্থার নিদর্শন।"

চীনা নও-মুসলিম ইউলি  ইসলামের নানা বিধান ও পবিত্র কুরআনের তাফসিরসহ ধর্ম শিক্ষার নানা ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন। বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.) সম্পর্কে যতই জানছেন ততই আল্লাহর নৈকট্য বেশি অনুভব করছেন সুমাইয়া বা সাবেক ইউলি।  তার এসব অভিজ্ঞতা ও ইসলাম সম্পর্কে নানা তথ্য তিনি পরিবারকেও অবহিত করছেন চিঠির মাধ্যমে। প্রকৃতি ও বিশ্বজগতের দিকে তাকালে আল্লাহর নিদর্শন দেখা যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন নিজের বোনের কাছে লেখা এক চিঠিতে। সুমাইয়ার বিশ্বাস, তার বোন একজন শিক্ষিকা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছেও এইসব কথা তুলে ধরছেন। চীনা নও-মুসলিম ইউলি নিজ দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আগ্রহী। তবে এর আগে তিনি নিজে ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চান যাতে এ ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে দুই বার কাছ থেকে দেখেছেন চীনা নও-মুসলিম ইউলি। তিনি তাঁর মধ্যে ইসলামের নুর দেখতে পেয়েছেন। সুমাইয়ার মতে, এই মহান নেতা সব মুসলমানেরই পথ প্রদর্শক। বিশ্বে ইসলামের অগ্রগতিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা প্রভাব রয়েছে। বিদেশী নও-মুসলিমদের জন্য নানা ধরনের সহযোগিতার কারণে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন,

"আমি জানিনা কিভাবে এইসব স্নেহের প্রতিদান দেব, মহান আল্লাহ হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামনেয়ীকে রক্ষা করুন।"

খোদা সম্পর্কে প্রকৃতিগত আগ্রহ ইউলিকে ইরান পর্যন্ত টেনে এনেছে। তিনি ভবিষ্যতে ইসলাম ধর্ম প্রচারক হতে চান। তার জীবন বিশ্বের যুব সমাজের জন্য আদর্শ হোক।  

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৭