সুরা 'আসরা' বা বনি ইসরাইলের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা বনি ইসরাইলের ৩৯ নম্বর আয়াতের পর থেকে একত্ববাদ ও শিরক সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। এরপর মহান আল্লাহর মহত্ত্ব তুলে ধরতে বিভিন্ন সৃষ্টিকুল যে আল্লাহর তসবিহ বা প্রশংসা করছে তা তুলে ধরে বলা হয়েছে:
'(৪৪) সাত আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা আছে সবই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছে না, কিন্তু তোমরা অবশ্য তাদের পবিত্রতা ঘোষণা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় সহনশীল, ক্ষমাশীল।'
প্রতিটি অস্তিত্বই কোনো না কোনোভাবে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছে। মহান আল্লাহকে পাওয়ার আকুল আর্তির শব্দ সব স্থানেই শোনা যাবে। কিন্তু অসচেতন ব্যক্তিরাই তা শুনতে পায় না। আর যাদের অন্তর ঈমানের নূরে উজ্জ্বল তারা এ শব্দ বা আকুতি ঠিকই শুনতে পান। তসবিহ বলতে পবিত্রতা ও ত্রুটিহীনতা তুলে ধরাকে বোঝায়। অস্তিত্বের বিস্ময়কর জগত এটাই তুলে ধরছে যে এই বিশ্ব জগতের স্রস্টা সব ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং মহাকৌশলী ও মহামহিম আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতা অসীম।
সুরা বনি ইসরাইলের ৭১ ও ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
'(৭১) স্মরণ কর, যেদিন আমরা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে তাদের ইমাম বা নেতাসহ আহ্বান করব; এবং যাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে, তারা তাদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের ওপর সামান্যতম অবিচারও করা হবে না। (৭২) যে এখানে তথা ইহকালে অন্ধ, সে পরকালেও অন্ধ এবং বেশি পথভ্রষ্ট।'
ইবনে মারদুইয়্যা হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এই ৭১ নম্বর আয়াতের তাফসীরে বলেছেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ জামানার ইমাম, নিজ প্রতিপালকের কিতাব এবং নিজ নবীর সুন্নতসহ আহূত হবে।’ (তাফসীরে দুররে মানসুর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯৪ দ্রষ্টব্য)
এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক যুগেই একজন ইমাম থাকা জরুরি। এ হিসেবে বর্তমান যুগে ইমাম মাহদী (আ.)-অবশ্যই জীবিত বা উপস্থিত রয়েছেন বলে মনে করা হয় ।
সুরা বনি ইসরাইলের ৭২ নম্বর আয়াতের তাৎপর্য হল, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তি থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করে না এবং হেদায়েতের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকে, তার আখিরাতে মুক্তির পথ দৃষ্টিগোচর হবে না।
সুরা বনি ইসরাইলের ৭৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
'(৭৮) সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে এবং বিশেষভাবে যত্নবান হও ফজরের পঠন বা নামাযের বিষয়ে; কারণ, ফজরের পঠন বা নামাজ ফেরেশতাদের প্রত্যক্ষের বিষয়।'
নামাজ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় আল্লাহর কথা এবং মানুষের অন্তর থেকে পাপের পঙ্কিলতা দূর করে। নামাজ মানুষের মনকে সুস্থ রাখে ও মানুষকে পাপ আর কদর্যতা থেকে দূরে রাখে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে সুরা বনি-ইসরাইলের ৭৮ ও ৭৯ নম্বর আয়াতে। তবে এই ওয়াক্তগুলো সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত বর্ণনা আসেনি। এই সুরার কয়েকটি আয়াতে কুরআনের প্রভাব ও গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। সুরাটির ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
'(৮২) আমরা কুরআন থেকে তা-ই অবতীর্ণ করে থাকি যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও অনুগ্রহ; কিন্তু তা জালিমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া কিছুই বাড়ায় না।'
পবিত্র কুরআন থেকে কেবল বিশ্বাসীরাই উপকৃত হয়। সুরা বাকারার প্রথম আয়াতেও এ কথা বলা হয়েছে যে, কেবল খোদাভীরু বা বিশ্বাসীদেরই সুপথ দেখায় কুরআন। বিশ্বাসীদের মন ও প্রাণের ওপর কুরআনের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। কুরআন মানুষের নানা নৈতিক ও চিন্তাগত রোগ দূর করে। যারা কুরআন থেকে শিক্ষা নেন তারা নানা মহৎ মানবীয় গুণের অধিকারী হন এবং খোদায়ী নানা গুণের প্রভাব পড়ে তাদের মধ্যে।
অনেকের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে যারা ঈমানদার নয় তাদেরকে কি আল্লাহ পাপ করতে বাধ্য করেন? এর উত্তর হল না। বরং যে ঈমান আনে না তার অবস্থা অন্ধকারের জীবের মত। সে আলো পায় না বলে বিপথে যায় বা বিভ্রান্ত হতেই থাকে। অন্যদিকে বিশ্বাসী ব্যক্তি আলোর মাধ্যমে পথের যে কোনো বাধা-বিপত্তি বা প্রতিকূলতাগুলোকে দেখতে পায়। ফলে সে সাবধানে ও সতর্ক হয়ে পথ চলতে পারে।
কিংবা বিষয়টিকে লাইনে থাকা রেলগাড়ি বা সড়কে থাকা গাড়ির সঙ্গে তুলনা করা যায়। যে গাড়ি পথ থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে বা পনিতে চলে যায় সেটাকে প্রথমে তার চলার জন্য নির্ধারিত পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট বা কাঙ্ক্ষিত পথে গাড়িটিকে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। যতক্ষণ না সেটাকে গাড়ির রাস্তায় আনা না হবে ততক্ষণ তাকে সঠিক লক্ষ্যে বা পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। একই কথা প্রযোজ্য ট্রেনের ক্ষেত্রেও। তদ্রূপ মানুষকেও আগে বিশ্বাস ও ঈমানের পথে এসে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। এরপর আল্লাহর দেখানো নুর বা কুরআনের আলো তাকে এগিয়ে নেবে সঠিক পথের দিকে তথা সৌভাগ্য ও মুক্তির দিকে এবং এভাবে সে পাপ ও অশ্লীলতা বা কদর্যতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এমন তৌফিক দিন যাতে আমরা ইসলামের শিক্ষাগুলোকে ভালোভাবে রপ্ত করতে পারি এবং এই শিক্ষাগুলোকে জীবনে কাজে লাগাতে পারি। সমস্ত নেয়ামতের জন্য মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ও বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে অশেষ দরুদ আর সালাম পাঠিয়ে শেষ করছি আসমানি সুরার আজকের আলোচনা। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি ধন্যবাদ।#