‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৫)
জামাই শহর দেখতে যাবে তাই বাদশাহ আদেশ দিলো সংশ্লিষ্ট শহরকে যেন সাজানো হয়। তারপর মালেক মুহাম্মাদ দরবারের কতিপয় অভিজাত ব্যক্তিকে নিয়ে মন্ত্রীর শহরের দিকে রওনা দেয়। মালেক মুহাম্মাদের ছয় ভাইয়ের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের।
তারা এই শহরেই কেউ ভিক্ষা করে খায়, কেউবা টুকটাক চাকর বাকরের কাজ করে। তারা যখন শুনলো যে বাদশার মেয়ের জামাই যাবে ওই শহর দেখতে,তারা প্রস্তুত হলো শহরে যেতে এবং রাজকন্যার জামাইকে দেখতে। তাদের যে তিন ভাই ভিক্ষা করতো তারা বললো যে এই শহরের তো তিনটা প্রবেশদ্বার রয়েছে। সুতরাং তিন দ্বারে তিনজন যাবো এবং হুক্কা সাজাবো জামাইর জন্য। বাদশার জামাই যদি খুশি হয় তাহলে নিশ্চয়ই কিছু দেবে।
যেই কথা সেই কাজ। তিন ভাই লেগে গেল হুক্কা সাজানোর কাজে। হুক্কা সাজিয়ে পরিকল্পনামতো বিভিন্ন গেইটে তারা দাঁড়ালো। মালেক মুহাম্মাদ প্রথম প্রবেশদ্বারে যেতেই হুক্কা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখতে পেল। ওই যুবক মালেকের কাছাকাছি যেতেই মালেক তাকে চিনতে পারলো। যুবক মালেকের হাতে হুক্কাটা দিলো। দু’এক টান দিয়ে মালেক হুক্কাটা যুবকের হাতে ফেরত দিয়ে সামনে অগ্রসর হলো। বাকি দুই গেইটেও অন্য দু’ভাইকে হুক্কা হাতে পেল এবং এক-দুই টান দিয়ে তাদেরকেও হুক্কা ফেরত দিয়ে অগ্রসর হয়ে গেল নিজের পথে। এই দুই ভাইও মালেক মুহাম্মাদকে চিনতে পারলো না।
এদিকে মালেক মুহাম্মাদ গিয়ে পৌঁছলো উৎসব অনুষ্ঠানে। সেখানে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে তার জন্য সাজানো রাজকীয় আসনে বসলো। হঠাৎ দেখ পেল হাম্মামের রক্ষণাবেক্ষণকারী তার চাকরকে বলছে: বাদশার জামাই হাম্মামে আনছে। তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস! কোনো কাজ করছিস না! যা,হাম্মামের উষ্ণতা আরও বাড়িয়ে দে। মালেক মুহাম্মাদের দৃষ্টি পড়লো ওই চাকরের ওপর। দেখেই চিনতে পারলো এ-ও তার আরেক ভাই। অপরপ্রান্তেও তাকিয়ে দেখলো বাবুর্চি তার চাকরকে বলছে: দুপুর হয়ে গেছে, এখন বাদশার জামাই খাবার খেতে আসবে। অথচ তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস!
হাতের ওপর হাত রেখে আরাম করছিস! মালেক মুহাম্মাদের দৃষ্টি গেল সেদিকে। দেখলো ওই চাকরও তার আরেক ভাই। মালেক মুহাম্মাদ ঘাড় ফেরালো অন্যদিকে। দেখলো ঠিক সেই মুহূর্তেই নেহারির বাবুর্চি তার চাকরকে বলছে: কাল সকালে বাদশার জামাই আমার কাছ থেকে নেহারি খেতে চাইবে। অথচ তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিস! মালেকের দৃষ্টি গেল ওই চাকরের দিকে। দেখলো এই চাকরও তারই আরেক ভাই।
মালেক মুহাম্মাদ তার সকল ভাইকেই ঠিকঠাকমতো চিনতে পারলো। কিন্তু ভাইয়েরা তাকে চিনতে পারলো না। মালেক মুহাম্মাদের আর সহ্য হচ্ছিল না। তার সঙ্গে আসা বাহিনীকে আদেশ দিলো মন্ত্রীর শহরে যেন হামলা চালায়। কিন্তু জিহ্বাকাটা মন্ত্রী আদেশ শুনে মালেক মুহাম্মাদের হাত পা জড়িয়ে ধরলো। অনুনয় বিনয় করে বোঝালো সে যেন তার সেনাদেরকে ফেরায়। মালেক মুহাম্মাদ বললো: এক শর্তে আমি তাদের থামাতে পারি। শর্তটা হলো এক্ষুণি তোমার বাবুর্চি, হাম্মামের ওস্তাদ এবং নেহারি প্রস্তুতকারী ওস্তাদকে আমার সামনে হাজির করবে।
জিহ্বাকাটা মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাদের তিনজনকেই ডেকে পাঠালো। তিনজনই যখন জামাইর সামনে এলো জামাই আদেশ দিলো তিনজনকেই যেন হালকা চড় দেওয়া হয়। তাই করা হলো এবং বুঝিয়ে দিলো তারা যেন আর কখনো তাদের চাকরদের চড়-থাপ্পড় না মারে।
মালেক মুহাম্মাদ ভাইদের সবাইকে চিনতে পেরে মনে মনে বললো: এরা তো সবাই জুয়াড়ি। সম্ভবত জুয়া খেলে ভাইয়েরা তাদের সব টাকা পয়সা হারিয়ে বসেছে। সে কারণেই তাদের আজ এই দশা। এই ভেবেচিন্তে মালেক আদেশ দিলো সকল জুয়াড়িকে যেন তার সামনে হাজির করা হয়। সবাইকে হাজির করা হলে মুহাম্মাদ তাদের থাপ্পড় মেরে তিরষ্কার করে। তারপর জুয়াড়িদেরকে তার ভাইদের দেখিয়ে বলে: এদের কাছ থেকে যত টাকা তোরা জুয়া খেলে নিয়েছিস,সব টাকা ফেরত দে! জুয়াড়িরা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিলো এবং অচেনাদের কাছ থেকে যা কিছু নিয়েছিল সব ফেরত দিলো।
মালেক মুহাম্মাদ এবার আদেশ দিলো: তিন প্রবেশদ্বারে যে তিনজন হুক্কা সাজিয়ে তাকে দিয়েছিল তাদেরকে যেন হাজির করা হয়। আদেশ দেয়ামাত্র তাদের হাজির করা হলো। মালেক মুহাম্মাদ ছয় ভাইকে নিয়ে আড়ালে গেল। এরপর ছয় ভাইকে বললো: “খুব ভালো করে আমার দিকে তাকাও!...আমি তোমাদেরই ভাই”। সবাই তাকালো এবং মালেক মুহাম্মাদকে চিনতে পারলো। লজ্জায় ছয় ভাই তাদের মাথা নীচু করে রাখলো। মালেক মুহাম্মাদ হেসে দিয়ে বললো: যা হবার তো হয়েই গেছে! এখন আর লজ্জা পেয়ে কাজ নেই। সবাই আমার সঙ্গে চলো রাজপ্রাসাদে। তাদেরকে রাজকীয় পোশাক পরানো হলো। ওই পোশাক পরেই তারা প্রাসাদে ঢুকলো।
মালেক মুহাম্মাদ বাদশার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো: হে বাদশাহ! আমার ভাইয়েরা আমাদের দেশ থেকে এসেছে। আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে এবং সোনার খাঁচা আর ময়না পাখি নিয়ে আসতে হবে। বাদশাহ মালেক মুহাম্মাদকে সফরে যাবার অনুমতি দিলো এবং সকল প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হলো ঘোড়ায় চড়ে।