সুরা মারিয়ামের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা (এক)
হযরত ঈসা (আ.)'র জন্ম-কাহিনী এবং একত্ববাদের বিষয়ে বর্ণনার পর সুরা মারিয়ামে হযরত ইব্রাহিম (আ)'র জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে এই মহান নবীও তাওহীদ বা একত্ববাদের আহ্বান জানিয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে নিজের বাবার সঙ্গে ইব্রাহিম (আ)'র বিতর্কেরও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। অবশ্য পবিত্র কুরআনের অনেক তাফসিরকারক মনে করেন এখানে বাবা বলতে যাকে বোঝানো হয়েছে তিনি ছিলেন আসলে ইব্রাহিম (আ.)'র চাচা বা পালক পিতা।
ইব্রাহিম (আ.) প্রথমেই একত্ববাদের দাওয়াত শুরু করেছিলেন একান্তই ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে। কারণ, আপনজনদের মধ্যে প্রভাব খাটানো অন্যদের চেয়ে বেশি সহজ।
সুরা মারিয়ামের ৪১ থেকে ৫০ নম্বর আয়াতে হযরত ইব্রাহিম (আ)'র দাওয়াতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একত্ববাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
'যখন তিনি তাঁর বাবাকে বললেন: হে পিতা, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজে আসে না, কেন তার ইবাদত কর? হে পিতা, আমার কাছে এমন ওহির জ্ঞান এসেছে; যা তোমার কাছে আসেনি, তাই আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব। হে আমার পিতা, শয়তানের ইবাদত করো না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য। হে পিতা, আমি আশঙ্কা করি, দয়াময়ের শাস্তি তোমায় স্পর্শ করবে, এরপর তুমি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবে। বাবা বলল: হে ইব্রাহীম, তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, আমি অবশ্যই পাথর ছুঁড়ে তোমায় হত্যা করব। তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও। ইব্রাহীম বললেন: তোমার উপর শান্তি হোক, আমি আমার পালনকর্তার কাছে তোমার জন্যে ক্ষমা চাইব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি মেহেরবান। আমি ছাড়ছি তোমাদেরকে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত কর তাদেরকে; আমি আমার পালনকর্তার ইবাদত করব। আশা করি, পালনকর্তার ইবাদত করে আমি বঞ্চিত হব না। এরপর তিনি যখন তাদেরকে এবং তাঁর আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত তারা করত,তাদের সবাইকে পরিত্যাগ করলেন,তখন আমি তাঁকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকুব এবং তাঁদের সবাইকে নবী করলাম। আমি তাঁদের দান করলাম আমার অনুগ্রহ এবং তাদের দিলাম সমুচ্চ সুখ্যাতি।'
এখানে ইব্রাহিম (আ.) এই বাস্তবতা শেখাচ্ছেন যে মানুষ যদি সত্য ও সরল পথে অগ্রসর হতে না পারে ও সত্যকে চিনতে না পারে তাহলে তারা শয়তানের ফাঁদে পড়ে বিভ্রান্ত হবে। কিসে রয়েছে মানুষের কল্যাণ- তা চিনতে হবে মানুষকে কোনো ধরনের অন্ধ অনুসরণ ও সত্য সম্পর্কে বিদ্বেষ ছাড়াই। কিন্তু সত্য সম্পর্কে বিদ্বেষ বা মিথ্যার অন্ধ-অনুকরণের কারণে ইব্রাহিম (আ)'র যৌক্তিক ও কল্যাণকামী আহ্বান তাঁর পালক বাবার অন্তরে কোনো প্রভাব ফেলেনি। ফলে তিনি সুপথ পাননি। ইব্রাহিম (আ.) সত্য ও তাওহীদের আহ্বানে অবিচল থাকায় কাফির-মুশরিকরা তার ঘোর শত্রু হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন ইসহাক ও ইয়াকুব (আ)। এই দুই মহান নবীও খোদায়ী মিশন তথা একত্ববাদের আহ্বান জানাতে গিয়ে নানা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাই মহান আল্লাহও তাঁদেরকে পবিত্রতা, খোদাভীতি, জিহাদ ও আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের বাস্তব আদর্শে পরিণত করেছেন।
এরপর সুরা মারিয়ামে মহান আল্লাহর নির্বাচিত পছন্দনীয় ব্যক্তি ও রাসূল হযরত মুসা (আ)'র আন্তরিকতা ও পবিত্রতা নিয়ে বক্তব্য এসেছে। অন্য কথায় মুসা (আ.) ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র পথেরই নতুন দিশারী। তিনি সেই পথেরই আরও বিকাশ ঘটিয়েছেন। সুরা মারিয়ামের ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে ইব্রাহিম (আ.)'র পুত্র ইসমাইল (আ.) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
'এই কিতাবে ইসমাইলের কথা বর্ণনা করুন, তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসূল, নবী। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে নামায ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি তাঁর পালনকর্তার কাছে পছন্দনীয় ছিলেন।'
এরপর সুরা মারিয়ামে মহান আল্লাহর নবী হযরত ইদ্রিসের (আ.) কথা এসেছে এভাবে:
'এই কিতাবে ইদ্রিসের কথা আলোচনা করুন,তিনি ছিলেন সত্যবাদী নবী। আমি তাঁকে উচ্চে উন্নীত করেছিলাম।' এরপর আগের কয়েক আয়াতের বক্তব্যের উপসংহার টেনে ৫৬ থেকে ৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'এরাই তাঁরা-নবীগণের মধ্য থেকে যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা নেয়ামত দান করেছেন। এরা আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহন করিয়েছিলাম, তাঁদের বংশধর,এবং ইব্রাহীম ও ইয়াকুব তথা ইসরাইলের বংশধর এবং যাদেরকে আমি পথ প্রদর্শন করেছি ও মনোনীত করেছি,তাদের বংশোদ্ভূত। তাদের কাছে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াতগুলো আবৃত্তি করা হত,তখন তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ত এবং কাঁদতো।'
এরপর সুরা মারিয়ামে এমন লোকদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে যারা নবী-রসূলদের আদর্শ থেকে দূরে থেকেছে ও আল্লাহ সম্পর্কে ছিল উদাসীন। এই সুরার ৫৯ থেকে ৬১ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
'এরপর তাদের পরে এল অপদার্থ পরবর্তীরা। তারা নামায নষ্ট করল এবং কু-প্রবৃত্তির অনুসারী হল। তাই তারা অচিরেই পথভ্রষ্টতা প্রত্যক্ষ করবে।
কিন্তু তারা ছাড়া,যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে। সুতরাং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের উপর কোন জুলুম করা হবে না।
তাদের স্থায়ী বসবাস হবে যার ওয়াদা দয়াময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে অদৃশ্যভাবে দিয়েছেন। অবশ্যই তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে।'
আজ আসমানি সুরার আলোচনা এখানেই শেষ করছি। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি অনেক ধন্যবাদ। #