সূরা আশ-শুআরা; আয়াত ৬৩:৬৮ (পর্ব-১০)
কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের এ পর্বে সূরা শুআরার ৬৩ থেকে ৬৮ নম্বর আয়াতের তরজমা ও তাফসির উপস্থাপনা করা হবে। এ সূরার ৬৩ থেকে ৬৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانْفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ (63) وَأَزْلَفْنَا ثَمَّ الْآَخَرِينَ (64) وَأَنْجَيْنَا مُوسَى وَمَنْ مَعَهُ أَجْمَعِينَ (65) ثُمَّ أَغْرَقْنَا الْآَخَرِينَ (66)
“অতঃপর মুসার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তোমার ষষ্ঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত করো, ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যকে ভাগ বিশাল পর্বত সদৃশ হয়ে গেল।” (২৬:৬৩)
“আমি সেখানে উপনীত করলাম অপর দলটিকে (অর্থাৎ ফেরাউনের বাহিনীকে)।” (২৬:৬৪)
“এবং মুসা ও তার সকল সঙ্গীকে উদ্ধার করলাম।” (২৬:৬৫)
“তৎপর অপর দলটিকে নিমজ্জিত করলাম।” (২৬:৬৬)
আগের আসরে আমরা বলেছি, অত্যাচারী রাজা ফেরাউন পূর্ণ শক্তি ও বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হযরত মুসা (আ.) ও তার সঙ্গীদের ধাওয়া করে। যখন বনি-ইসরাইল জাতি বিশাল নীল নদের সামনে আসে তখন তারা বাকি তিন দিক দিয়ে ফেরাউনের বাহিনী দ্বারা নিজেদেরকে অবরুদ্ধ দেখতে পায়। একদিকে নদীর প্রচণ্ড ঢেউ অন্যদিকে হিংস্র ফেরাউন বাহিনী। চারদিক দিয়ে জীবন বিপণ্ন দেখে হযরত মুসার সঙ্গীরা প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন।
কিন্তু হযরত মুসা (আ.) জানতেন ফেরাউনের হাত থেকে বনি-ইসরাইল জাতির মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবেই। এ কারণে তিনি নিজ সঙ্গীদের আশার বাণী শুনিয়ে বললেন: ওরা কখনোই আমাদের ধরতে পারবে না। যে আল্লাহ তোমাদেরকে নিয়ে মিশর ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন সেই আল্লাহই আমাদেরকে পরিত্রাণের উপায় বলে দেবেন। এই চার আয়াতে আল্লাহতায়ালা হযরত মুসা (আ.)কে বলছেন: আপনি যে লাঠিটি ফেরাউনে সামনে নিক্ষেপ করার পর তা বিশাল অজগরে পরিণত হয়েছিল সেই লাঠিটি এবার উত্তাল নীল নদে নিক্ষেপ করুন। দেখবেন নদীর ভেতর অনেকগুলো রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে এবং পানির ঢেউগুলো একটার উপর আরেকটা উঠে গিয়ে সুউচ্চ পাহাড় সৃষ্টি হবে।
হযরত মুসা আল্লাহর কথামতো তার হাতের লাঠি নীল দরিয়ায় নিক্ষেপ করেন। এ অবস্থায় হঠাৎ নীল নদের পানি বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। নদীর ঢেউগুলো একটির উপর আরেকটি উঠে উঁচু পাহাড় সৃষ্টি হয় এবং এগুলোর ভেতর দিয়ে অসংখ্য রাস্তা তৈরি হয়। হযরত মুসার নির্দেশে তার সঙ্গীরা এসব পথ দিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে চলে যান। ফেরাউন ও তার বাহিনী এত বড় মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা দেখার পরও আল্লাহর প্রতি ঈমান না এনে বরং বনি-ইসরাইল জাতিকে ধরার জন্য নীল নদে সৃষ্ট রাস্তাগুলো দিয়ে এগিয়ে চলে। কিন্তু এ সময় তারা বুঝতে পারেনি যে, তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। হযরত মুসার শেষ সঙ্গী নদী থেকে তীরে উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর নির্দেশে থেমে থাকা পানি আবার সচল হয়ে ওঠে এবং আগের মতো প্রবাহিত হতে শুরু করে। পানির তোড়ে ভেসে যায় অহংকারী ফেরাউন ও তার বিশাল বাহিনী। এভাবে অত্যাচারী ফেরাউনের দম্ভ চূর্ণ হয়ে যায় এবং চিরতরে তার অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যায়।
ফেরাউন নিজেকে সৃষ্টিকর্তা বলে দাবি করত এবং বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ে তার গর্বের শেষ ছিল না। কিন্তু সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে, বিশাল সেনাবাহিনীসহ নীল নদের পানিতে অসহায়ভাবে তার সলিল সমাধি হবে। এর আগে ফেরাউন নিজের চোখে হযরত মুসার হাতের লাঠিকে বিশাল অজগরে পরিণত হতে দেখেছিল। সেদিন হয়ত সে যাদুকরদের সাপের সঙ্গে হযরত মুসার তৈরি সাপের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারেনি। কিন্তু আজ যখন নীল নদের মাঝখানে শক্ত পথ তৈরি হতে দেখল তখন তার বোঝা উচিত ছিল, এটি মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এখানে মহান আল্লাহর হাত আছে। অহংকারের কারণে যদি হযরত মুসার প্রতি ঈমান নাও আনতে চাইতো তারপরও এতবড় অলৌকিক ঘটনা দেখে সে বনি-ইসরাইল জাতির পশ্চাদ্ধাবন করা থেকে বিরত থাকতে পারত সে। তা করলে ফেরাউন ও তার দলবল হয়ত আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা পেত।
এ চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. প্রকৃতি এবং এর বিভিন্ন উপাদান যেমন পানি ও মাটি অনেক সময় আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর খাঁটি বান্দাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং তাদের নির্দেশমতো পরিচালিত হয়।
২. আল্লাহর ইচ্ছার চেয়ে বড় কোনো কিছু নেই। তাঁর ইচ্ছায় একদিন যে লাঠি সাপে পরিণত হয় আরেকদিন ওই একই লাঠির কারণে সাগর শুকিয়ে মুমিনদের পরিত্রাণের জন্য রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। আবার কখনো ভূপৃষ্ঠের পানি বাস্পে পরিণত হওয়ার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই লাঠি ( এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৬০ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে)
৩. আল্লাহ চাইলে তাঁর বান্দাদের চরম কঠিন অবস্থা থেকেও উদ্ধার করেন।
সূরা শু'আরার ৬৭ ও ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُمْ مُؤْمِنِينَ (67) وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ (68)
“এতে অবশ্যই সুস্পষ্ট (শিক্ষা ও) নিদর্শন আছে, কিন্তু ওদের অধিকাংশই ঈমান আনে না।” (২৬:৬৭)
“এবং নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক মহা পরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু।” (২৬:৬৮)
হযরত মুসা ও ফেরাউনের কাহিনী বর্ণনা করার পর এই আয়াতে মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয়নবী (সা.) ও মুসলমানদের উদ্দেশ করে বলছেন: ফেরাউনের নীল নদে ডুবে যাওয়ার ঘটনায় তোমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। যারা ফেরাউনের মতো অত্যাচারী শাসক তাদের জন্য এ ঘটনায় যেমন শিক্ষা রয়েছে তেমনি এসব শাসকের হাতে নির্যাতিত জাতির জন্যও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
অত্যাচারী শাসকের জন্য যে শিক্ষা রয়েছে তা হলো, আল্লাহ চাইলে মুহূর্তের মধ্যে শাসকের ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে বিশাল সেনাবাহিনী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্রও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। নির্যাতিতদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, তারা যদি আল্লাহর প্রকৃত মুমিন কোনো বান্দার নেতৃত্বে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলে আল্লাহ এ কাজে তাদেরকে সাহায্য করবেন। যুগ যুগ ধরে বিশ্বজুড়ে মহান আল্লাহর এ রীতি কার্যকর হতে দেখা গেছে। কিন্তু এসব নিদর্শন দেখার পরও বেশিরভাগ মানুষ সত্য গ্রহণ করেনি এবং ঈমান আনেনি। ফেরাউনের সামনে নীল নদের ভেতরে রাস্তা তৈরি হওয়ার ঘটনায় আল্লাহর অসীম ক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেলেও সে ঈমান আনেনি যার ফলে তাকে ধ্বংস হয়ে যেতে হয়েছে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. কেউ যদি সত্যিই মনেপ্রাণে আল্লাহকে পেতে চায় তাহলে তার সামনে এত বেশি নিদর্শন রয়েছে যা দেখে সে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে।
২. সত্যের অনুসারীদের সাহায্য করা এবং অত্যাচারীকে ধ্বংস করাই আল্লাহর রীতি।
৩. মহান আল্লাহ অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস বর্ণনা করে বিশ্বনবী (সা.) ও মুমিন বান্দাদের সান্ত্বনা দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে ধৈর্যধারণের শক্তি যুগিয়েছেন।#