রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ছিল মারাত্মক ভুল: জেনারেল ইবরাহিম
বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার যে ঘোষণা মিয়ানমার দিয়েছে তা কেবল সময়ক্ষেপণ এবং কৌশলী অবস্থান। রেডিও তেহরানকে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ন্যাশনাল সলিডারিটি ফর দ্যা রোহিঙ্গা মোর্চার আহ্বায়ক মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ছিল মারাত্মক ভুল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেয়া হবে বলে কিছুদিন আগে মিয়ানমারের একজন মন্ত্রী আলোচনা করে গেছেন। কিন্তু এখন খবর পাওয়া যাচ্ছে- রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে এবং এতে অস্বস্তিতে পড়েছে ঢাকা। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম : দেখুন, মিয়ানমার কৌশলী অবস্থান নেবে একথাটা বাংলাদেশের বেশিরভাগ চিন্তাশীল মানুষ আগে থেকেই অনুমান করেছিল। অথচ বাংলাদেশের সরকার কেন এটা অনুমান করে নি, কেন বিষয়টি মাথায় রাখে নি এটা তাদের ব্যর্থতা এবং অদক্ষতা। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিকমহলের সমালোচনার কারণে রোহিঙ্গা বিষয়ে একটা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের সেই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সরকারকে এবং আন্তর্জাতিকমহলকে আপাতত আশ্বস্ত করা এবং সময়ক্ষেপণের রাস্তা বের করা। আর সেই কাজটা তারা সাফল্যের সাথে করেছে।

রেডিও তেহরান: ১৯৯২ সালের চুক্তিকে ভিত্তি ধরে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কথা বলছে মিয়ানমার। কিন্তু ঢাকার কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা মনে করছে, এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ১৯৯২ সালের চুক্তিকে ভিত্তি ধরে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর ঘোষণা কেবল সময়ক্ষেপণ। আপনার কী মনে হয়?
সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম: দেখুন, এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। মিয়ানমার সরকার আসলে সময়ক্ষেপণের জন্যই এটি করছে। আর একথাটি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার সময় অর্থাৎ কয়েক দিন আগে ঢাকায় মিয়ানমার সরকারের স্টেটকাউন্সিলর অফিসের মন্ত্রী মহোদয় এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে ঘন্টা দেড়েকের আলোচনা হয়। সে সময় ১৯৯২ সালের চুক্তির বিষয়টি আসে নি। যদি আসত তাহলে দুই মন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ে আমরা সেটা দেখতে পেতাম।
রেডিও তেহরান: মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাটা হলো-সে সম্পর্কে আপনি কি বলবেন।
সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম: আমি মূলত তাদের মধ্যকার আলোচনাকেই সমালোচনা করছি। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসাই বাংলাদেশের উচিত হয় নি বলে মনে করি। আমার প্রশ্ন- মিয়ানমারের স্টেটকাউন্সিলর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অন সান সুচি আন্তর্জাতিকমহলের উদ্দেশ্যে নিজ দেশের রাজধানীতে দেয়া ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এড়িয়ে গেছেন। তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত বলেন নি। এমন একটি ভান করেছেন যে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। সেখানে আমাদের কল্পনারও বাইযে যে কী মনে করে সেখানকার একজন মন্ত্রী মাত্র দেড় ঘন্টার আলোচনা করে কীভাবে সিদ্ধান্ত দিল যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। তাদের এই কথাটা বিশ্বাস করাটাই বাংলাদেশের জন্য ভুল ছিল। আর সেজন্যেই আমি বলব আসলে বাংলাদেশের অবস্থানটা দুর্বল ছিল।
রেডিও তেহরান: এ প্রসঙ্গে আমরা আরো একটু জানতে চাইব-সেটি হচ্ছে ১৯৯২ সালের চুক্তি এবং আজকের প্রেক্ষাপট কী একধরনের নাকি পার্থক্য রয়েছে।
সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম: ১৯৯২ সালের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে- একথাটা যেমন সত্য একইসাথে এটাও সত্য যে আলোচনার সময় ফয়সালা করা উচিত ছিল কোন্ নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে। সে বিষয়টি ফয়সালা না করে কেন তাঁর সাথে আলোচনা শেষ করা হলো। ফলে এ বিষয়টি আমাদের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে আছে। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ও সম্মানিত কূটনীতিবিদরা কী একথাটি বুঝতে পারেন নি যে, কাকে বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া আর কাকে বলে আন্তরিক আলোচনা!
রেডিও তেহরান: রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার সরকার যদি ফেরতও নেয় তাহলে কী এই নিশ্চয়তা আসছে যে, তাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যা তথা জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে না? এই নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য জাতিসংঘ কিংবা শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি দরকার কী না?

সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম: দেখুন, আপনার প্রশ্নের সাথে আমি শতভাগেরও চেয়েও বেশি একমত। এ বিষয়ে আমি বলতে চাই, যদিও আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। তবে আমার জীবনের অভিজ্ঞতার জায়গাটা শুধু রাজনীতি নয়। আর আমার জীবনের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে বলতে চাই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে অবশ্যই তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে দ্বিপাক্ষিক কোনো আলোচনা সফল হবে না।
রেডিও তেহরান: আচ্ছা আপনি কেন এমনটি বলছেন, যে দ্বিপাক্ষিকভাবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে না?
সৈয়দ মুহাম্মাদ ইবরাহিম: আমি প্রথমেই প্রশ্ন রেখে বলতে চাই যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী একথা কেন ভুলে গেলেন যে, মিয়ানমার সরকার শুধুমাত্র তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এখানে আলোচনায় আসে নি।
এখন যদি আন্তর্জাতিকমহল বলে হ্যালো বাংলাদেশ, তুমিই তো নিজেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করে ফেলছ- আমাদের আর দরকার কী? তখন বাংলাদেশ কী উত্তর দেবে? আসলে এখানে মিয়ানমারের দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছে। আর বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশ সরকার চাচ্ছে তড়িঘড়ি করে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটা সাফল্যের পরিমণ্ডল মানুষের সামনে তুলে ধরতে। তাঁরা দেখাতে চেয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার সফলতা অর্জন করেছে। মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করতে এসেছে এবং সমাধান দিচ্ছে।
তবে আমি মনে করি এবং বাংলাদেশের সবাই মনে করে যে, আওয়ামী লীগ সরকার মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় গিয়ে মারাত্মক ভুল করেছে। কারণ বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো বন্ধু ধারে কাছে নেই। ভারত রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে। ত্রাণ দেয়া বা সাড়ে চার বিলিয়ন লোন দেয়া এক জিনিষ আর বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে একমতপোষণ করে দাঁড়ানো আরেক জিনিষ। ভারত যে বাংলাদেশের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে সেটাতে প্রলেপ দেয়ার জন্য এবং মাথায় হাত বুলানোর জন্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী।
দুঃখের বিষয় আমাদের খাদ্যমন্ত্রী মিয়ানমারে খাদ্য কিনতে গিয়েছিলেন। এটা খুবই ন্যাক্কারজনক ঘটনা। একইসাথে এ সময় ভারতের অর্থমন্ত্রীর ঢাকা সফর এবং তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করাটাও আমাদের জন্য ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এসব ঘটনা মিয়ানমার থেকে আসা সাড়ে ৬ লক্ষ মানুষের সাথে পরিহাস বটে। আমরা চাই এখানে সার্ক, ওআইসি অথবা জাতিসংঘকে সংযুক্ত করা হোক।
আমি বলব জাতিসংঘ বিষয়ক যে শরণার্থী সংস্থা আছে তাদেরকে এখানে সংযুক্ত করতেই হবে। মিয়ানমার আসিয়ানের সদস্য। আসিয়ানের দুটো গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালেয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। দেশ দুটি বাংলাদেশের পক্ষে আছে। তাদেরেকও এখানে জড়িত করা হচ্ছে না। কোন্ স্বার্থে এটা করা হচ্ছে। আমি সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম নামক বাংলাদেশের একজন বিনীত নাগরিকের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন রাখছি।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৭