ডিসেম্বর ২০, ২০১৭ ১৭:১৬ Asia/Dhaka

গত কয়েক আসরে আমরা বলেছি, ইসলামের প্রাথমিক যুগে কুরআন শিক্ষা ও চর্চাকেন্দ্র হিসেবে মসজিদ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

নবুওয়াত প্রাপ্তির পরবর্তী মক্কার প্রতিকূল পরিবেশেও মাঝেমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের নিয়ে মসজিদুল হারামে সমবেত হতেন। সেখানে তিনি সবাইকে কুরআন পড়ে শোনাতেন এবং তাদেরকে হালাল-হারাম সম্পর্কে নানা বিষয় শিক্ষা দিতেন। কখনো কখনো এই মসজিদুল হারামেই কুরাইশ বংশের মুশরিক সর্দারদের সঙ্গে আল্লাহর একত্ববাদ ও তৌহিদ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করতেন তিনি।

মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর এই শিক্ষাকেন্দ্র মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে নববীতে স্থানান্তরিত হয়। আল্লাহর রাসূল (সা.) সাধারণত ফজর অথবা এশার নামাজের পর বক্তৃতা দিতেন এবং এলমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। এসব আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত পবিত্র কুরআনের তাফসির। এ ছাড়া, মসজিদে আয়োজিত হতো নানা ধরনের শিক্ষামূলক ক্লাস। বিশ্বনবী (সা.) এসব ক্লাসের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, তিনটি বিশেষ অবস্থা ছাড়া মসজিদে অবস্থান করা জায়েয নেই। এক. নামাজের পর কুরআন তেলাওয়াত, দুই. জিকির-আসগার ও তসবিহ-তাহলিল করা এবং তিন. ধর্মীয় বিষয় শিক্ষাদান বা শিক্ষাগ্রহণ।

নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী করার পাশাপাশি দ্বীন শিক্ষার জন্য মুসলমানরা মসজিদে সমবেত হন। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদ ছিল মুসলিম সমাজের একমাত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। পরবর্তীতে মসজিদের একাংশে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও থাকার জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি করা হয়। ইরানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে আজও এ ধরনের মসজিদ চোখে পড়ে। এ কারণে মসজিদ ও মাদ্রাসা বাহ্যিক দিক দিয়ে দু’টি আলাদা শব্দ হলেও ব্যবহারিক দিক দিয়ে এই দু’টি স্থাপনা প্রায় অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এমনকি দেশে দেশে ব্যাপকভাবে মাদ্রাসা ছড়িয়ে পড়ার পরও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মসজিদের গুরুত্ব এখনো অটুট রয়েছে।

অষ্টম শতকের বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাগদাদ জামে মসজিদে হাদিস শিক্ষার ক্লাসের কথা উল্লেখ করেছেন যে ক্লাসে তিনি নিজেও হাদিস শিখতে যেতেন। অথচ সেই একই সময়ে কুরআন ও হাদিস শিক্ষার জন্য বাগদাদে বড় বড় অনেকগুলো মাদ্রাসা ছিল। ঠিক এ কারণে ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানরা মসজিদকে কখনো মাদ্রাসা আবার মাদ্রাসাকে কখনো কখনো মসজিদ বলে ফেলতেন। ব্যবহারিক দিক দিয়ে এই দু’টি নামকে আলাদা করে দেখা হতো না এবং শত শত বছর ধরে এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।  কখনো কখনো সুফি-দরবেশদের সমাবেশস্থল, খানকা বা দরবার শরীফও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

শুরুতে যেমনটি বলেছি, এবারে কায়রোর সবচেয়ে প্রাচীন ও বিখ্যাত মসজিদ, মসজিদে আল-আজহার নিয়ে আলোচনা করব। এটির নাম মসজিদ হলেও এটির ভেতরে রয়েছে বিশাল এক মাদ্রাসা। উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে বড় রাজবংশ ফাতেমিদের শাসনামলে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফাতেমি খলিফারা নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.আ.)’র নামে নিজেদের বংশের নাম রেখেছিলেন। এ কারণে অনেকে মনে করেন, ফাতেমিদের প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদের নাম জাহরা থেকে আল-আজহার রাখা হয়েছে।  আবার কেউ কেউ বলেন, আল-আজহার শব্দের অর্থ হচ্ছে ঔজ্জ্বল্য; মিশরের অন্যান্য স্থাপনা থেকে এই মসজিদ ভবন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল বলে এর নাম দেয়া হয়েছে আল-আজহার।

৩৫৯ হিজরি মোতাবেক ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ ফাতেমি খলিফা মুয়িজ লিদিনিল্লাহ’র সেনাপতি ও মিশর জয়ের নায়ক জওহার কাতিব সিকিলি’র হাতে আল-আজহার মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৩৬১ হিজরির রমজান মাসে প্রথম এই মসজিদে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ৩৬৫ হিজরিতে এই মসজিদের প্রথম শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। আলী ইবনে নুমান এই মসজিদে সমবেত আলেমদের সামনে তার পিতার লেখা ‘আল-ইখতিসার’ বইটি পড়ে শোনান এবং প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল আল-আজহারে অনুষ্ঠিত প্রথম সেমিনার। ওই বছর মুয়িজ লিদিনিল্লাহ’র নির্দেশে আলী ইবনে নুমান শিয়া মাজহাবের শিক্ষাগুলো উপস্থাপনের জন্য এই মসজিদে বিশেষ  ক্লাসের ব্যবস্থা করেন।

শুরুতে আল-আজহারের দু’টি অংশ ছিল। এর একাংশে ছিল মসজিদ ভবন এবং আরেক অংশে ছিল বিশাল আঙ্গিনা। মসজিদ ভবনেরও ছিল আবার দু’টি অংশ। প্রথম অংশ তৈরি হয়েছিল ৭৬টি মর্মর পাথরের স্তম্ভ দিয়ে। মুসল্লিরা মূলত এই অংশে নামাজ আদায় করতেন। প্রতি চারটি স্তম্ভের ভেতর ছিল একটি করে নামাজ আদায়ের কক্ষ যার মধ্যে ছিল মুসল্লিদের দাঁড়ানোর জন্য পাঁচটি করে কাতার। এই কাতারগুলো মেহরাবের দিকে চলে যাওয়া একটি বড় করিডোরে গিয়ে মিলিত হতো। T-আকৃতির এই নির্মাণশৈলী আল-আজহারের আগে উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য মসজিদেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। মসজিদের দ্বিতীয় অংশ নির্মাণ করা হয় আরো পরে যেখানে রয়েছে মর্মর পাথরের ৫০টি স্তম্ভ। এই অংশটি বর্তমানে মসজিদের পুরনো মেহরাবের পেছনে পড়েছে।

৪০০ হিজরিতে ফাতেমি রাজবংশের ষষ্ঠ খলিফা আল-হাকিম বি-আমরিল্লাহ মসজিদটিতে বড় ধরনের সংস্কার করেন এবং শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা নির্মাণের জন্য বিশাল অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ দেন। তিনি খলিফার পাঠাগারের সব বই ও কিতাব আল-আজহারের লাইব্রেরিতে দান করে দেন।

আজ আমরা যে আল-আজহার মসজিদ দেখতে পাই তার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে নির্মিত আল-আজহার মসজিদের আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কারণ, এই মসজিদের দিকে প্রতিটি যুগের মুসলিম শাসকদের সুদৃষ্টি ছিল এবং তারা সব সময় এটির শ্রীবৃদ্ধির দিকে মনযোগী ছিলেন। এসব শাসক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং নিজেদের রুচি অনুযায়ী মসজিদের একাংশ ভেঙে ফেলে নতুন ডিজাইনে সেটিকে পুনর্নির্মাণ করতেন অথবা সম্পূর্ণ নতুন কোনো অংশ এতে সংযোজন করতেন। এ কারণে বিভিন্ন ইসলামি ও আরব শাসকদের নির্মাণশৈলীর যাদুঘরে পরিণত হয়েছে এই মসজিদ।

বর্তমানে বিশালাকৃতির আল-আজহার মসজিদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ ও পাঁচটি মিনার। মসজিদটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ধনুকাকৃতির জানালা যা প্রথম তৈরি হয়েছিল ফাতেমি শাসনামলে।

ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় আল-আজহার মসজিদকে অনেক ঘটনাপ্রবাহ ও চড়াই-উৎড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন- আইয়ুবীদের শাসনামলে এই মসজিদের দিকে শাসকদের কোনো দৃষ্টি ছিল না এবং টানা প্রায় ১০০ বছর এখানে জুমার নামাজ আদায় হয়নি। ৭০২ হিজরিতে কায়রোয় সংঘটিত শক্তিশালী ভূমিকম্পে আল-আজহার মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মিশরের তৎকালীন শাসক এটি মেরামত করে দেন।

হিজরি অষ্টম ও নবম শতক ছিল আল-আজহার মসজিদের চরম উৎকর্ষের যুগ। এ সময় ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভুগোল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোতে পাঠদান শুরু হয়। ধীরে ধীরে আল-আজহার মসজিদের পাশাপাশি এটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি পায়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেক বড় জ্ঞানীগুণী ও পণ্ডিত। এসব পণ্ডিতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন ইবনে খালদুন, আল-মাকরিজি, ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আস-সাখাভি এবং আস-সুয়ুতি। এ ছাড়া, সমসাময়িক যুগের যেসব আলেম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সা’দ জাগলুল, মোহাম্মাদ আবদু এবং তাহা হুসেইন প্রমূখ।

ফাতেমি শাসকদের আধিপত্যের যুগে আল-আজহার ছিল শিয়া মাজহাব চর্চার কেন্দ্র। ফাতেমিরা চেয়েছিলেন সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মাজহাব ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু সালাহউদ্দিন আইয়ুবি মিশর দখল করার পর আল-আজহারে সুন্নি মাজহাব প্রবর্তন করেন। তার শাসনামলে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক মাজহাব ইসমাইলিয়া শিয়া থেকে সুন্নি শাফিয়ি মাজহাবে রূপান্তর করা হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/২০

ট্যাগ