সুরা ক্বাফের প্রাথমিক পরিচিতি ও কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা ক্বাফ পবিত্র কুরআনের পঞ্চাশতম সুরা। মক্কায় নাজিল হওয়া এই সুরায় রয়েছে ৪৫ আয়াত। বিচ্ছিন্ন অক্ষর ক্বাফ দিয়ে শুরু হয়েছে বলে এ সুরার নাম হয়েছে ক্বাফ।
এই সুরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হল পরকাল তথা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন। সুরা ক্বাফের প্রায় সব বক্তব্যই আবর্তিত হয়েছে এই পরকাল বা পুনরুত্থানের বিষয়কে কেন্দ্র করে।
এই সুরায় বক্তব্য এসেছে পবিত্র কুরআনের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব,পরকালের প্রতি কাফিরদের অবিশ্বাস, বিশ্বজগতের সমাপ্তি ও কিয়ামতের কিছু ঘটনা, বেহেশতি ও দোযখীদের অবস্থা,মহান আল্লাহর প্রতি মনোযোগ এবং তাঁর ইবাদত করা সম্পর্কে। এ ছাড়াও সৃষ্টি-জগত আর এর ব্যবস্থাপনা ও প্রাথমিক সৃষ্টিকে পরকালের বাস্তবতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা, অতীতের খোদাদ্রোহী জাতিগুলোর পরিণতি, বিচার-দিবসের জন্য মানুষের কথা ও কাজকে রেকর্ড করা, মৃত্য এবং ইহজগত থেকে অন্য জগতে মানুষের স্থানান্তর সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে সুরা ক্বাফে।
এই সুরার প্রথম তিন আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'ক্বাফ! সম্মানিত কুরআনের শপথ; বরং তারা তাদের মধ্য থেকেই একজন ভয় প্রদর্শনকারী এসেছে দেখে বিস্ময় বোধ করে। এরপর কাফেররা বলেঃ এটা বিস্ময়কর ব্যাপার। আমরা মরে গেলে এবং মাটিতে পরিণত হয়ে গেলেও কি আবারও জীবিত হব তথা পুনরুত্থিত হব? এ প্রত্যাবর্তন সুদূরপরাহত।'
-কাফিররা এটা দেখে বিস্মিত যে মহান আল্লাহর নবী বা রাসুল তাদের মতই একজন মানুষ! মানুষ মরে গিয়ে পঁচে যাওয়ার পর আবারও জীবিত হতে পারে-এটাও তাদের কাছে মহাঅবিশ্বাস্য ও হাস্যকর ব্যাপার!
কাফিরদের এই অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের জবাবে মহান আল্লাহ বলছেন, সব কিছুর বিষয়ে তাঁর জ্ঞান রয়েছে। আমাদের শরীরের যা-ই মাটির সঙ্গে মিশে যাক না কেন আল্লাহ তা জানেন এবং দরকার হলে তিনি আবারও তা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। আর মানুষের কাজকর্মের বিচার করা হবে পুনরুত্থান বা বিচার-দিবসে। এই সব বিষয়ই মহান আল্লাহর বিশেষ ফলকে সংরক্ষণ ও রেকর্ড করা আছে। মানুষের কোনো কাজই সেই রেকর্ড থেকে হারিয়ে যাবে না।
সুরা ক্বাফের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
'বরং তাদের কাছে সত্য আগমন করার পর তারা তাকে মিথ্যা বলছে। ফলে তারা সংশয়ে পতিত রয়েছে। তারা কি তাদের উপরস্থিত আকাশের দিকে তাকায় না আমি কিভাবে তা নির্মাণ করেছি এবং গ্রহ-নক্ষত্র দিয়ে সুশোভিত করেছি? তাতে কোন ছিদ্রও নেই।'
-অর্থাৎ তারা জেনেশুনে সত্যকে অস্বীকার করছে। অন্য কথায় সত্য তাদের কাছে স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আর জেনেশুনে সত্যকে অস্বীকার করার কারণে তারা সব সময়ই মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকে। এরপর এখানে আকাশের দিকে তাকাতে বলতে তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বলা হচ্ছে। এই সুন্দর ও বিস্ময়কর অসীম আকাশ আর বায়ুমণ্ডল অথচ তাতে নেই কোনো ফাটল বা ছিদ্র কিংবা অন্য কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি অথবা নিয়মহীনতা ও ভারসাম্যহীনতা। এই বায়ুমণ্ডল ও আকাশ মানুষের জন্য ছাদ ও সুরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করছে। ফলে উর্ধ্বআকাশ থেকে ছুটে আসা কোনো কঠিন শিলা বা পাথর পৃথিবীর কাছে আসার আগেই পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
মহান আল্লাহ এরপর জমিন সম্পর্কে বলছেন:
'আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালার ভার স্থাপন করেছি এবং তাতে সব ধরনের নয়নাভিরাম উদ্ভিদ উদগত করেছি। এটা জ্ঞান আহরণ ও স্মরণ করার মত ব্যাপার প্রত্যেক অনুরাগী বান্দার জন্যে। আমি আকাশ থেকে অজস্র বরকতে ভরপুর বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা দিয়ে বাগান ও তা থেকে শস্য উদগত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। এবং সরল-লম্বা খর্জুর বৃক্ষ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খর্জুর বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ এবং বৃষ্টি দিয়ে আমি মৃত জনপদকে সঞ্জীবিত করি। এমনিভাবেই মৃতরা জীবিত হবে ও কবর থেকে মানুষের পুনরুত্থান ঘটবে।'
-এই আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নানা নিদর্শন এমনভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যাতে আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে পরকাল এবং মৃত অস্তিত্বকে জীবিত করার প্রমাণ হিসেবেও তুলে ধরা যায়। আর এরই ভিত্তিতে অসীম আকাশের বিস্ময়কর নানা দিকের বর্ণনা পর জমিনের বিস্ময়কর নানা নিদর্শনের প্রসঙ্গটি এনেছেন মহান আল্লাহ। সুবিস্তৃত জমিনের মধ্যে পরস্পর-সংলগ্ন পাহাড় ও পর্বতমালা ভেতর ও বাইরের চাপের মোকাবেলায় ভূমির জন্য খুঁটি বা ঢালের কাজ করে। ভূমিতে গজানো নানা ধরনের সুদৃশ্য ও কোমল উদ্ভিদ মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতারই নিদর্শন। মহান আল্লাহ বলছেন এসব বিষয়কে তিনি সেইসব মানুষের জন্য অর্ন্তদৃষ্টি ও আল্লাহর স্মরণের মাধ্যম করেছেন যারা তওবাকারী। যে মহান আল্লাহ অজস্র সম্পদে ভরপুর এমনসব মহাকাশ ও জমিন এবং এ সংক্রান্ত নানা ব্যবস্থা ও নিয়ম সৃষ্টি করতে পারেন তিনি কি মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারবেন না?
শীতকালের পর মৃতপ্রায় গাছে আবার পাতা ফিরে আসে এবং ফুলে ফলে সুশোভিত হয় গাছপালা। এভাবে বৃষ্টি বর্ষণের পর মৃত প্রান্তর আবারও হয়ে ওঠে সবুজ-শ্যামল। তাই এটা স্পষ্ট যে বিশ্বজগতের স্রষ্টা ইচ্ছে করলে আবারও মৃতদের জীবিত করতে পারেন। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/০১