"যারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিকে ভয় করে তাদের জন্যে রয়েছে নিদর্শন": সুরা জারিয়াত
গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম সুরা জারিয়াতে অতীতের নবী-রাসুল ও কয়েকটি জাতির কিছু শিক্ষণীয় ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এইসব শিক্ষণীয় ঘটনার প্রথমেই রয়েছে লুত নবীর (আ) জাতিকে শাস্তি দেয়ার জন্য হযরত ইব্রাহিম (আ)'র কাছে মানুষের ছবি ধরে ফেরেশতাদের আগমন।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে সুরা জারিয়াতের ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
'আপনার কাছে ইব্রাহিমের সম্মানিত মেহমানদের কাহিনী এসেছে কি? যখন তারা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল: সালাম,তখন সে বলল: সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক।'
অপরিচিত একদল মেহমান হযরত ইব্রাহিম (আ)'র কাছে আসলে তিনি তাদেরকে ঘরে নিজ পরিবারের কাছে নিয়ে আসেন আপ্যায়ন করার জন্য। তিনি তাদেরকে খাবার খেতে দিয়ে সবিস্ময়ে দেখেন যে তারা খাবারের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন না। তখন তিনি মেহমানদের বললেন: আপনারা কি খাবার খান না? মেহমানদের এই অবস্থা থেকে মহান আল্লাহর এই নবী কিছুটা ভয়ও পেয়ে যান। তখন মানুষের বেশধারী ওই ফেরেশতারা বললেন:
'ভীত হবেন না। তারা তাঁকে একটু জ্ঞানীগুণী পুত্র সন্তানের অধিকারী হওয়ার সুসংবাদও দেন।'
এ সময় হযরত ইব্রাহিম নবীর স্ত্রী সামনে এগিয়ে এসে বিস্ময়-ভরা আনন্দ-চিত্তে বলে ওঠেন যে : যদিও আমি একজন বন্ধ্যা বৃদ্ধা নারী তা সত্ত্বেও আমি কি সন্তানের অধিকারী হব? ফেরেশতারা বললেন: আপনার পালনকর্তা এরূপই বলেছেন। নিশ্চয়ই তিনি প্রজ্ঞাময়,সর্বজ্ঞ।
-অর্থাৎ মহান আল্লাহ যখন কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ইচ্ছা করেন তখন তার বাস্তবায়ন হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
হযরত ইব্রাহিম (আ) মানুষের বেশধারী ও মেহমান হিসেবে আসা ফেরেশতাদের অবস্থা ও আচরণ দেখে বুঝতে পারলেন যে তারা তাকে কেবল সন্তান লাভের সুসংবাদ দেয়ার জন্য তার কাছে আসেননি,বরং তাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজও রয়েছে। তাই এ অবস্থায় তিনি ফেরেশতাদের বললেন:
হে প্রেরিত ফেরেশতারা,আপনাদের উদ্দেশ্য কি? তারা বলল: আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের কাছে যাতে তাদের উপর মাটির ঢিলা নিক্ষেপ করে ধ্বংস করে দেই।
- এরা ছিল লুত নবীর জাতি। তারা শিরকসহ নানা ধরনের পাপাচারে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে তাদের সবচেয়ে বড় পাপ ও সীমালঙ্ঘন ছিল সমকামিতা যা অত্যন্ত জঘন্য ও অপছন্দীয় কাজ। আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো মাটির ঢিলার বৃষ্টি বর্ষণ করে এই মহাপাপী জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ফেরেশতারা।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে সুরা জারিয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: এরপর সেখানে যারা ঈমানদার ছিল,আমি তাদেরকে উদ্ধার করলাম এবং সেখানে একটি ঘর ছাড়া কোনো বিশ্বাসী বা মু’মিন আমি পাইনি।
-অর্থাৎ লুত নবীর জাতি যে জনপদগুলোতে বসবাস করত সেখান থেকে খোদায়ি আজাব নাজিল হওয়ার আগে সব মু’মিনদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়। অবশ্য ওইসব শহর বা জনপদগুলোর মধ্যে কেবল একটি পরিবার ছিল ঈমানদার। অন্য কথায় একমাত্র লুত নবীর পরিবার ওই আজাব থেকে মুক্তি পেয়েছিল। তবে লুত নবীর স্ত্রী বিভ্রান্ত ছিলেন বলে তাকেও ওই খোদায়ী আজাব থেকে মুক্তি দেয়া হয়নি।
ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পে ও এরপর মাটির ঢিলার বৃষ্টি বর্ষণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল লুত নবীর জাতি। তাদেরকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়ার ঘটনা ছিল অন্য জাতিগুলোর জন্য শিক্ষণীয় ঘটনা।
এই ঘটনার শেষাংশ তুলে ধরা হয়েছে সুরা জারিয়াতের ৩৭ নম্বর আয়াতে। মহান আল্লাহ বলছেন: যারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিকে ভয় করে,আমি তাদের জন্যে সেখানে একটি নিদর্শন রেখেছি।
মানুষের মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে যে কেনো আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এই দুনিয়ায় আমাদের পাঠানোর উদ্দেশ্যটা কি? সুরা জারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে এ প্রশ্নের উত্তরেই মহান আল্লাহ বলছেন: আমি আমার ইবাদত করার জন্যই মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। - এখন প্রশ্ন হলো মহান পরওয়ারদেগার তথা প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত করা বলতে কি বোঝায়?
ইবাদত হল মহান আল্লাহর সামনে সর্বোচ্চ মাত্রায় বিনীত হওয়া। ইবাদত হল মানব-সৃষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য যা আদায় করতে মহান আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। তাই মানুষ যাতে আল্লাহর ইবাদত করে তথা আল্লাহর দাসত্ব করে সেজন্য তাকে দান করেন জ্ঞান ও সচেতনতা।
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাকে পরিপূর্ণতা দেয়ার এক মহান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। আর এ জন্যই যে মানুষের কোনো অস্তিত্ব ছিল না তাকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে অস্তিত্ব। তাই যে এক সময় ছিল না সে আজ আছে। এর পরের প্রক্রিয়ার অংশ হল শিক্ষা ও ধর্মীয় কর্মসূচি।
মহান আল্লাহ সমস্ত নেয়ামত ও কল্যাণের উৎস। তিনি তার সৃষ্টিকে অপূর্ণতা থেকে থেকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছান। তাই মহান আল্লাহর দাসত্ব করা তথা তাঁর ইবাদত করা হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্লাস।
অন্য কথায় আল্লাহর দাসদের উচিত তাঁকে চেনা যিনি সব পরিপূর্ণতার উৎস। অবশ্য মনে রাখা দরকার মহান আল্লাহর পরিপূর্ণতার গুণের মোকাবেলায় অন্য সব কিছুর বা সব সৃষ্টির পূর্ণতা হচ্ছে আপেক্ষিক। কিন্তু বান্দাহ বা দাসদের উচিত মহান আল্লাহর পরিপূর্ণতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া যাতে মহান আল্লাহর এই গুণের প্রতিফলন ঘটে দাসের মধ্যেও। কারণ মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য খোদার রঙ্গে রঙ্গিন হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। মোট কথা আল্লাহর দাসত্ব করার অর্থ হল নিজেকে মহান আল্লাহর অসত্ত্বাগত গুণগুলোর আলোয় আলোকিত করা। আর এটাই হল মানুষের পরিপূর্ণতা।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/১৫