"কোনো চিন্তাশীল আছে কি যে উপদেশ গ্রহণ করবে?"
সুরা কামার-এর ৬ থেকে ৮ নম্বর আয়াতে কিয়ামত ও বিচার-দিবসে মানুষের কাজকর্মের বিচারের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলছেন:
'অতএব,আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। যেদিন আহবানকারী আহবান করবে এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে,তারা তখন প্রবল ভয়ের কারণে চোখ নামিয়ে রেখে কবর থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মত। তারা আহবানকারীর দিকে দৌড়াতে থাকবে। কাফেররা বলবেঃ এটা কঠিন দিন।'
-কিয়ামতের ঘটনাগুলো এতোই ভয়াবহ যে তা তাকিয়ে দেখার সাহস কারোই নেই। তাই মানুষ সেইসব ঘটনার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দৃষ্টিকে নিচের দিকে রাখবে। কিয়ামত শুরু হওয়ার পর ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষকে পঙ্গপালের সঙ্গে তুলনার কারণ হল বহু ধরনের পাখির বিপরীতে পঙ্গপালরা কোনো ধরনের শৃঙ্খলা ও লাইন বজায় রেখে এগিয়ে চলে না। বরং এইসব পতঙ্গ জগা-খিচুড়ির মত তালগোল পাকিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে।
অন্ধকার হৃদয় এবং পাপ ও খোদাদ্রোহিতায় নিমজ্জিত লোকেরা কিয়ামতের দিন এতই ভীত-সন্ত্রস্ত হবে যে তারা আত্ম-অচেতন মাতালের মত সব দিকেই ছোটাছুটি করবে। ফলে তাদের পরস্পরের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কাধাক্কি হতে থাকবে। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ বলছেন: যখন তারা আহ্বানকারীর আহ্বানে তথা শিঙ্গায় ফু দেয়ার ফলে সৃষ্ট শব্দ শুনে কবর থেকে বেরিয়ে আসবে তখন তারা ভয়ানক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘাড় নামিয়ে খুব দ্রুত আহ্বানকারীর দিকে ছুটে আসবে। সেদিনের কঠিন অবস্থায় ভয়ে কাফিরদের সমস্ত অস্তিত্ব জড়সড় হয়ে পড়বে এবং তারা বলবে: আজকের দিনটি খুবই কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক দিবস।
সুরা কামার খোদাদ্রোহী ও কাফির-মুশরিকদেরকে অজুহাতকামীতা এবং একগুয়েমি বা গোড়ামির বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে যে তারাও যেন হযরত নুহের জাতি, আ’দ ও সামুদ জাতি এবং লুত নবীর জাতি ও ফেরাউন আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়। কারণ মুশরিক ও অপরাধীদের পরিণতি হল দোযখ।

সুরা কামারের নয় নম্বর আয়াতের পর থেকে খোদাদ্রোহী ওই জাতিগুলোর পরিণতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। গোড়ামি ও কুফরির তথা সত্যকে অস্বীকারের পরিণতি যে খোদাদ্রোহী ওই প্রত্যেক জাতিকেই ভোগ করতে হয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। হযরত নুহ নবীর জাতি ছিল খোদাদ্রোহী ওই জাতিগুলোর অন্যতম। নুহ (আ) যখন দেখলেন যে তার জাতি সুপথে আসছে না ও ভবিষ্যতেও সুপথে আসবে না তখন তিনি মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে বললেন:
অবশেষে সে তথা নুহ তার রবকে উদ্দেশ করে বললো;আমি খোদাদ্রোহী এই জাতির কাছে হয়েছি পরাজিত,তাই আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
পরের আয়াতে নুহ নবীর জাতির ওপর খোদায়ি শাস্তি নেমে আসার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে: তখন আমি আসমানের দরজাগুলো খুলে দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। এবং সমগ্র ভূভাগ বিদীর্ণ করে ঝর্ণাধারায় রূপান্তরিত করলাম৷ আর ওইসব পানির সবটাই সেই কাজ পূর্ণ করার জন্য সংগৃহীত হলো যা আগে থেকেই সুনিদিষ্ট ছিল৷
-অর্থাৎ একদিকে আকাশ থেকে প্রবল বৃষ্টি-বর্ষণ ও অন্যদিকে সমগ্র ভূভাগ বিদীর্ণ হয়ে পানি ঝর্ণার মতো উঠে আসায় ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। আর এভাবে গোটা বিশ্ব যেন পরিণত হয় মহাসমুদ্রে। এর ওপর দেখা দেয় প্রবল তুফান।
এর পরের আয়াতে বলা হয়েছে:
আর নূহকে (আ) আমি কাষ্ঠফলক ও বহু পেরেকের মাধ্যমে নির্মিত বাহনে তথা কিশতিতে আরোহন করিয়ে দিলাম।
এরপর মহান আল্লাহ হযরত নুহের সেই কিশতি বা বিশাল নৌকার বিষয়ে বিশেষ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলেছেন: এই কিশতি চলতো আমার দৃষ্টির সামনে।
অর্থাৎ বিশাল ঢেউয়ের বুক চিরে চলতো নুহ নবীর কিশতি। মহান আল্লাহর দৃষ্টি ও সুরক্ষার কারণেই তা প্রবল ঢেউ সত্ত্বেও এগিয়ে চলছিল কোনো অসুবিধা ছাড়াই। এভাবে হযরত নুহ নবী ও তাঁর সঙ্গীরা ওই মহাপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু বাদ-বাকি সব অবিশ্বাসী মানুষেরা ডুবে মারা যায়।
এরপর মহান আল্লাহ এই ঘটনার শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা এই ঘটনাকে শিক্ষা গ্রহণের এক নিদর্শনরূপে রেখে দিয়েছি। অতএব,কোন চিন্তাশীল আছে কি যে শিক্ষা নেবে ও সতর্ক হবে?
হযরত নুহ (আ)'র ঘটনা তুলে ধরার পর সুরা কামারে আ'দ, সামুদ ও লুত জাতির এবং এরপর ফেরাউন ও তার দলবলের ধ্বংস হওয়ার কাহিনীও বলা হয়েছে । খোদাদ্রোহী এই জাতিগুলোর শিক্ষণীয় প্রতিটি কাহিনীর পর অত্যন্ত আবেদনময় একটি বিশেষ ও অভিন্ন বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই বাক্যে মহান আল্লাহ বলছেন: আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে তথা উপদেশ গ্রহণের সুবিধার্থে। অতএব, কোনো চিন্তাশীল আছে কি যে উপদেশ গ্রহণ করবে?
সুরা কামারের শেষের দিকের কয়েকটি আয়াতে মহান আল্লাহ কাফের ও মুমিনদের পরিণতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে বলেছেন:
নিশ্চয়ই সেদিন অপরাধীরা পথভ্রষ্ট ও বিকারগ্রস্ত। যেদিন তাদেরকে মুখ হিঁচড়ে টেনে নেয়া হবে জাহান্নামে,বলা হবেঃ আগুনের তৈরি খাবারের স্বাদ আস্বাদন কর। আমি প্রত্যেক বস্তুকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় বা পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি। আমার কাজ তো এক মুহূর্তে চোখের পলকের মত। আমি তোমাদের সমমনা লোকদেরকে ধ্বংস করেছি,অতএব,কোন চিন্তাশীল আছে কি যে উপদেশ গ্রহণ করবে ? তারা যা কিছু করেছে,সবই আমলনামায় লিপিবদ্ধ আছে। ছোট ও বড় সবই লিপিবদ্ধ। (৪৭-৫৩)
এরপর কাফিরদের পরিণতি তুলে ধরার পর বিশ্বাসী ও ধার্মিকদের আনন্দায়ক ও মহাসুখময় পরিণতি সম্পর্কে সুরা কামারে মহান আল্লাহ বলছেন:
'খোদাভীরুরা থাকবে উদ্যান তথা জান্নাতে ও নির্ঝরিণী বা নহরের পাশে। যোগ্য আসনে,সর্বাধিপতি মহাসম্রাটের সান্নিধ্যে।' (৫৪-৫৫)
-বেহেশত এমন এক স্থান যাতে নেই কোনো মিথ্যা ও অর্থহীন কোনো কিছুর অবকাশ। বেহেশতে যা যা দেয়া হবে বলে মহান আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তার সবই বেহেশতিরা প্রত্যক্ষ করবেন। বেহেশতিরা থাকবেন সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। সর্বশক্তিমান স্রস্টার সান্নিধ্যে থাকা মেহমানদের আপ্যায়নও হবে সর্বশ্রেষ্ঠ আপ্যায়ন যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো হৃদয় তা অনুভব বা কল্পনাও করেনি এবং শুনেনি কোনো কান। বেহেশেতের বস্তুগত সুখের কথা আগে উল্লেখ করার পর চরম সুখ তথা মহান আল্লাহর সান্নিধ্যের কথা বলা হয়েছে। এর কারণ মানুষের আত্মাকে পর্যায়ক্রমে উন্নতির দিকে নেয়া হয়। বস্তুগত সুখ হচ্ছে আধ্যাত্মিক সুখের প্রস্তুতি পর্ব।
শেষোক্ত এ দুই আয়াত মহান আল্লাহর রহমত ও নৈকট্যের ছায়াতলে মুমিনকে দেয় চরম প্রশান্তি ও আল্লাহর ওপর ভরসার চরম গ্যারান্টি ।
অস্তিত্ব ও বিশ্বজগতের সবকিছুর অবিসম্বাদিত ও নিরঙ্কুশ মালিক যে সব কিছুর ওপরই যে সর্বশক্তিমান এবং চরম কর্তৃত্বশীল-এই উপলব্ধি মানুষকে দেয় অভাবনীয় প্রশান্তি ও পূলক। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই প্রশান্তি দান করুন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ২৮