তথায় থাকবে আনতনয়না রমনীগণ : সুরা আর রাহমান
গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম সুরা আর রাহমানের ৩১ নম্বর আয়াতের পর থেকে পরকাল ও পরকালীন শাস্তি সম্পর্কিত কিছু বক্তব্য রয়েছে। এসব আয়াত পাপীদের জন্য সতর্কবাণী ও মু'মিনদের জন্য সচেতনতা, জাগরণ ও উৎসাহের মাধ্যম।
কিয়ামত বা বিচার দিবসে জিন আর মানুষের সব কথা ও কাজের এবং ইচ্ছার যথাযথ তদন্ত করা হবে। আর এরই আলোকে দেয়া হবে পুরস্কার ও শাস্তি। এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস আমাদের পার্থিব জীবন ও আল্লাহর নেয়ামত ব্যবহারের পদ্ধতি বা ধরনের ওপর প্রভাব ফেলে।
এই সুরায় কিয়ামত সম্পর্কিত যেসব বাক্য ও বক্তব্য রয়েছে তা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে কিয়ামতের দিন বিশ্বজগত লণ্ডভণ্ড হয়ে পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে এবং গোটা বিশ্ব জগতে ভয়ানক নানা ঘটনা ঘটবে। মহাকাশের ছায়াপথ, সৌরজগত, গ্রহ-নক্ষত্র এবং আকাশ ও জমিন –এসবই ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়াও ঘটবে এমন সব ঘটনা যা কেউ কখনও কল্পনাও করেনি।
কিয়ামত বা পুনরুত্থানের দিন সম্পর্কে সুরা আররাহমানের ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে তখন সেটি রক্তবর্ণে রঞ্জিত চামড়ার মত হয়ে যাবে।
- কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ ঘটনার আগাম ঘোষণা সব অপরাধী ও মু'মিনদের জন্য সতর্কবানী এবং তা সবার জন্যই মহান আল্লাহর এক বড় দয়া। আর এ জন্যই আয়াতটির পরই এখানেও এ সুরার সবচেয়ে পুনরাবৃত্তিমূলক বাক্যটি যুক্ত হয়েছে, যে বাক্যটিতে প্রশ্ন করা হয়েছে: অতএব তোমরা জিন ও মানুষ উভয়ই তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ নেয়ামত বা অবদানকে অস্বীকার করবে?

কিয়ামতের দিন তথা বিচার দিবসে পাপী ও জালিমদেরকে চেনা যাবে তাদের চেহারা থেকেই। এর অর্থ মানুষের চিন্তাভাবনা ও তৎপরতা তাদের চেহারা থেকেই বোঝা যায়। তাই পরকালে তথা বিচার-দিবসে অপরাধীদেরকে অত্যন্ত অপমানজনক অবস্থায় তাদের মাথার সামনের দিকের চুল টেনে এবং পা ধরে টেনে এনে জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলা হবে। আর তাদেরকে বলা হবে: এটাই হচ্ছে সেই জাহান্নাম যাকে অস্বীকার করতে তোমরা।
যারা বেহেশত ও দোযখ এবং বিচার-দিবসকে অস্বীকার করে তারা দোযখের অধিবাসী হবে। তাদেরকে আগুন ও উত্তপ্ত পানি আর যন্ত্রণা দেয়া হবে দোযখের মধ্যে।
সুরা আররাহমানের ৪৬ নম্বর আয়াতে বেহেশতবাসীদের অপার সুখ ও নজিরবিহীন আনন্দের আংশিক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। দোযখীদের নজিরবিহীন কিছুর শাস্তির দৃষ্টান্ত তুলে ধরার পাশাপাশি বেহেশতি সুখের এই চিত্র দেয়া হয়েছে যাতে বেহেশত ও দোযখ উভয়েরই বাস্তবতা সবার কাছে স্পষ্ট হয়।
৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দাঁড়ানোর ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান।
- বেহেশতে থাকবে অনেক উদ্যান যাতে যাওয়া-আসা করবে বেহেশতবাসীরা। আর এসব উদ্যান হচ্ছে সৎকর্মেরই প্রতিদান। এরপর বলা হচ্ছে:
উভয় উদ্যানই ঘন শাখা-পল্লববিশিষ্ট। … উভয় উদ্যানে আছে বহমান দুই প্রস্রবন।
এরপর বেহেশতি ফলমূলের কথা বলা হয়েছে সুরা আররাহমানে। মহান আল্লাহ বলছেন: সে দুই উদ্যান বা জান্নাতের উভয়ের মধ্যে প্রত্যেক ফল দুই বা বহু রকমের হবে।
- অর্থাৎ বেহেশতি ফলগুলো হবে বিচিত্রময় ও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের। প্রতিটি ফলকেই মনে হবে কোনো না কোনো দিক থেকে অন্য ফলগুলোর চেয়ে উন্নত ও আকর্ষণীয়।

এরপর বলা হয়েছে: তারা তথা বেহেশতিরা তাদের অবাসস্থলে রেশমের আস্তরবিশিষ্ট বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে। উভয় উদ্যানের ফল তাদের কাছে ঝুলবে।
- মানুষ যখন প্রশান্ত ও নিরাপদ অবস্থায় থাকে কেবল তখনই তারা কোনো কিছুর ওপর হেলান দেয়। আর বেহেশতিদের হেলান দিয়ে বসার বিষয় থেকেও বোঝা যায় যে তারা সেখানে চরম আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করবে।
আসলে বেহেশতি নেয়ামতগুলোকে যথাযোগ্য ভাষায় প্রকাশ বা বর্ণনা করা অসম্ভব। কারণ কোনো কান সেসব নেয়ামতের কথা শোনেনি, কোনো চোখ সেসব দেখেনি ও কোনো অন্তর তা কল্পনাও করেনি। কিন্তু তবুও বেহেশতি সুখ সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা দেয়ার জন্য বেহেশতের অশেষ নেয়ামতের মধ্য হতে দু-একটি নেয়ামতের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে মাত্র।
একই সুরা তথা সুরা আররাহামানে বলা হয়েছে, বেহেশতবাসীরা ইচ্ছা করা মাত্রই গাছের ফল ডালসহ ঝুঁকে পড়ে তাদের হাতে আসবে।
পবিত্র জীবন-সঙ্গিনী বেহেশতের আরেকটি বড় খোদায়ী নেয়ামত। সুরা আররাহমানের ৫৬ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলছেন:
তথায় থাকবে আনতনয়না রমনীগণ,কোন জিন ও মানব পূর্বে যাদের ব্যবহার করেনি।
- অর্থাৎ বেহেশতি প্রাসাদগুলোয় যে বেহেশতি নারীরা থাকবে তাদের দৃষ্টি স্বামী ছাড়া অন্য কারো ওপর পড়বে না তথা তাদের ভালোবাসা, আদর-সোহাগ ও মন-প্রাণ কেবল স্বামীর জন্যই নিবেদিত থাকবে এবং তারা এর আগে কখনও কোনো মানুষ বা জিনের মুখোমুখি হয়নি। অন্য কথায় বেহেশতি নারীরা কুমারি ও সব দিক থেকেই পবিত্র। আর এ বিষয়টি স্বামীদের জন্য অত্যন্ত বড় প্রাপ্তি।
এরপর বেহেশতি হুরিদের কমনীয়তা, রূপ ও সৌন্দর্যকে তুলনা করা হয়েছে চুনি বা রক্তবর্ণ মনি ও প্রবালের পেলবতা আর সৌন্দর্যের সঙ্গে। বেহেশতি নারীরা তাবুর মধ্যে পর্দানশীন অবস্থায় থাকবে বলেও এই সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
- সুরা আররাহমানের ৬০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
সৎকাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?
-যারা দুনিয়াতে ভালো কাজ করেছে ও করছে-এটা তাদের জন্য অত্যন্ত বড় ও প্রতিদানের সুনিশ্চিত ওয়াদা।
সুরা আররাহমান শুরু হয়েছে আল্লাহর রহমত ও নেয়ামতের বর্ণনা দিয়ে এবং শেষ হয়েছে মহান আল্লাহর মহিমা ও মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসার মধ্য দিয়ে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/ ৩১