সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৮ ১৭:৩৪ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৮০ : বিশ্বের মুসলমানদের জন্য স্পেনের তিক্ত বিচিত্র স্মৃতি

বিশ্বের মুসলমানদের জন্যে স্পেন তিক্ত মধুর বিচিত্র স্মৃতির ধারক। অবশ্য এইসব স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে প্রচুর অভিজ্ঞতার সম্ভার। ইসলামী বিশ্বের এই অংশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মুসলমানদের উত্থান এবং অবক্ষয়ের রহস্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।

আর এই নেপথ্য রহস্যগুলোর উন্মোচন নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের জন্যে খুবই উপকারী। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় তা হলো যেই স্পেনের মুসলিম সমাজ খ্রিষ্ট্রিয় অষ্টম শতক থেকে পনেরো শতক পর্যন্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অ্যাতো উচ্চস্থানে উন্নীত হয়েছিল, সেই মুসলিম স্পেন কেন অবক্ষয়ের রসাতলে যেতে যেতে অবশেসে ইতিহাসের অংশে পরিণত হলো, কেনইবা সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ভূগোলের অঙ্গন থেকে নিশ্চিহ্ন হবার পথে গিয়ে দাঁড়ালো? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে প্রথমে যেতে হবে স্পেনে মুসলমানদের মর্যাদা ও সম্মানের বর্ণনায় এবং তারপর যেতে হবে তার অবক্ষয় ও পতনের কারণগুলো বিশ্লেষণে।

খ্রিষ্টিয় অষ্টম শতকের ইউরোপীয় রাজনৈতিক মানচিত্রের প্রতি দৃষ্টি দিলে নজরে পড়বে সেই যুগের ইউরোপে বিশেষ করে বৃটেন, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মতো দেশগুলোতে যেখানে উন্নত আবাসিক এবং নাগরিক জীবনের ছোঁয়া লাগে নি, সেই সময়টাতে ইউরোপের দু’দিক থেকেই মুসলমানরা উন্নতি এবং অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। দক্ষিণ-পূর্বে তারা ধীরে ধীরে এগুচ্ছিলো আনাতোলি উপদ্বীপের দিকে, তারপর বলকানের দিকে। আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ফ্রান্সের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী এলাকার দিকে। মুসলমানদের এই অগ্রগতি আর উন্নতির সুবাদে সৃষ্টি হয়েছিলেন কালজয়ী অনেক মনীষী। আবুল কাসেম যাহরাভি, ইবনে তোফায়েল, ইবনে রুশদ কুরতুবি, ইবনে আব্দুল বার আন্দালুসির মতো ইতিহাসবিদ ও লেখক যেমন সৃষ্টি হয়েছিলেন তেমনি সৃষ্টি হয়েছেন যুগোত্তীর্ণ অনেক সাহিত্যিকও। এইসব শক্তিশালী সাহিত্যিক তাঁদের সৃজনশীল লেখালেখির সাহায্যে ইসলামের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে পশ্চিমে স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইসলামের বিজয়ের সময় স্পেনের অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। দাসপ্রথা ব্যাপকভাবে এখানে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন রোমের আশরাফ অর্থাৎ অভিজাতরা তাদের ধন-সম্পদের সুরক্ষার লক্ষ্যে এবং তাদের আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে ভিযিগুতদের সাথেও জোটবদ্ধ হয়েছিলো এবং এভাবেই তারা জনগণের ওপর তাদের জুলুম অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছিল। ভিযিগুত বলতে বুঝায় অ্যারায়ানিস্ট বা বিপথগামী খ্রিষ্টানদের অনুসারীদেরকে। এরা জনগণের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালাতো। এ কারণেই স্পেনের অত্যাচারিত নিরীহ জনগণ ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমানদের কাতারে এসে সমবেত হতে লাগলো। মুসলমানদের আট শ’ বছরের হুকুমাতকে আন্দালুসিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস তিনটি যুগপর্বে বিভক্ত করেছে।

প্রথম অংশে পড়বে দামেশকে উমাইয়া খেলাফতের অংশ বিশেষ। এই পর্বে পড়বে ৭১৬ খিষ্টাব্দ থেকে ৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস। এ সময় দামেশকের উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আযিয স্পেনের শাসক নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়ে সাম্‌হ বিন মালেক খুলানিকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেন। সামহ মুসলমানদের অধিকৃত এলাকা ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। আব্দুর রহমান গাফেকির সময় স্পেনের পরিস্থিতিতে ব্যাপক সংস্কার কাজ চালানো হয়। আব্দুর রহমানের পর আরবদের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং সেই মতপার্থক্যের রেশ স্পেন পর্যন্ত গড়ায়। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের মধ্যকার এই মতপার্থক্যের সুযোগ নেয় এবং স্পেনের উত্তর দিককার বেশ কিছু শহর তারা দখল করে নেয়।

স্পেনের এই পরিস্থিতিতে খ্রিষ্টিয় ৭৫০ সালে দামেশকেও উমাইয়া খিলাফতের অবসান ঘটে। অবশেষে স্পেনের তৎকালীন শাসক ইউসুফ বিন আব্দুর রহমান ফাহরির সেনারা উমাইয়াদের একজনের মাধ্যমে পরাজিত হয় এবং এভাবেই স্পেনে উমাইয়া হুকুমাতের গোড়াপত্তন ঘটে। স্পেনের ইতিহাসের পরবর্তী পর্ব এভাবেই “উমাইয়া শাসিত স্পেন” নামে খ্যাতি লাভ করে। উমাইয়া শাসক ছিলেন ষোলো জন। তারা প্রায় তিন শ’ বছর স্পেন শাসন করেন। স্পেনের সর্বপ্রথম উমাইয়া শাসক ছিলেন আব্দুর রহমান বিন মুয়াবিয়া বিন হিশাম এবং সর্বশেষ শাসক ছিলেন মুতামেদ বিল্লাহ। উমাইদের শাসনামরে স্পেনের উত্তরাঞ্চলের সীমানা বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। জনগণের ওপর এই দীর্ঘ সময়ে অনেক জুলুম নির্যাতনও হয়েছে। তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদও জানিয়েছে। ফকিহদের বিদ্রোহ, খান্দাকের ঘটনা, রাবযের বিদ্রোহের প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে।

তবে জনগণের এইসব বিদ্রোহ সহজে ছেড়ে দেওয়া হয় নি বরং কঠোরভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়েছে, ব্যাপক দমন নিপীড়নও চালাতে দ্বিধা করে নি তৎকালীন শাসকদল। তবে এই যুগপর্বটিও একেবারে নির্বিবাদে কাটে নি। শাসক গোষ্ঠির মাঝে ব্যাপক দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে। তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব সমাজের ওপরও প্রভাব ফেলে ধীরে ধীরে। সমাজে যখন দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয় তখন সম্পদবহুল এই অঞ্চলটিতে স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয় গৃহযুদ্ধ। আর সেই অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের জের ধরেই অবসান ঘটে উমাইয়া শাসনের। তিন শতাব্দি ধরে ব্যাপক শানশওকতের সাথে স্পেন শাসন করে উমাইয়া শেষ পর্যন্ত বিদায় নেয় ক্ষমতার মসনদ থেকে।

তৃতীয় পর্বটি ‘মালুক তাওয়ায়েফি”র শাসনপর্ব নামেই স্পেনের ইতিহাসে বিখ্যাত ছিল। ৪২২ হিজরি থেকে ৮৯৮ হিজরি পর্যন্ত এই পর্বটি বিস্তৃত। এ সময়পর্বে আভিজাত্য বিস্তারের রেশ ধরে বস্তুবাদী চেতনার চর্চা চলে। ফলে নৈতিকতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবক্ষয় দেখা দেয়। খ্রিষ্টানরাও বহুবার হামলা চালায়। হামলা চালিয়ে খ্রিষ্টানরা মুসলিম এই ভূখণ্ডের বহু শহর দখলও করে নেয়। হিজরি সপ্তম শতকের প্রথমার্ধের মধ্যেই খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের তথা স্পেনের প্রায় সবকটি শহর দখল করে নিয়েছিল। ব্যাপক প্রতাপ আর মর্যাদাপূর্ণ মুসলমান শাসিত স্পেনের বিশাল ভূখণ্ডের ছোট্ট কটি শহর ছাড়া পুরোটাই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। তো মুসলমানদের শাসনকালে ধর্মীয় জ্ঞানের বহু শাখার বিস্তার ঘটে। হাদিস, ফিকাহ, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, কালাম, স্থাপত্য, মৃৎশিল্প, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদির ব্যাপকভাবে চর্চা হয়েছিল। মুসলিম শাসিত স্পেনকে বলা যায় মধ্যযুগে ইসলামী ভূখণ্ড ও ইউরোপের মধ্যকার সাংস্কৃতিক বিনিময়ের উন্মুক্ত দ্বার। ইসলামী ঐতিহ্যের বহু নিদর্শন এখনো সেখানে অবশিষ্ট রয়েছে। সেখানে কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন