সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮ ১৮:২৯ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৮৭ : আফগানিস্তানে ইসলামী জাগরণ

আফগানিস্তানে ইসলামী জাগরণ এবং তার বিকাশের পেছনে বিভিন্ন রকম প্রেরণা ও চালিকাশক্তি কাজ করেছিল। এইসব চালিকাশক্তির অন্যতম ছিল আফগানিস্তানে সাংবিধানিক স্বাধীনতা।

১৯৬৪ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল সেই সংবিধানের ফলে আফগানিস্তানে বিচিত্র ক্ষেত্রে মোটামুটি স্বাধীন চিন্তার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন বিভিন্ন আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, রাজনৈতিক বহু দল গঠিত হয়েছিল, সাংগঠনিক কার্যক্রমের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এসেছিল এবং এককথায় সমাজ গঠনের সুষ্ঠু ও ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণেই কাবুলে বিচিত্র ঘটনা প্রবাহ আমরা লক্ষ্য করেছি। এইসব ঘটনা প্রবাহের ফলে একদিকে যেমন আফগানিস্তানের ওপর ‘মুহাম্মাদ যায়ি’ পরিবার বা বংশসহ বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠীর আধিপত্য কমে এসেছিল অপরদিকে বামপন্থী এবং ডানপন্থীরাও বিভিন্ন রকম তৎপরতা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

বামপন্থী চিন্তাধারার অধিকারীরা সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের কর্মতৎপরতা চালাতে পেরেছিল এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। একইভাবে যারা ইসলামী চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন তারাও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে তাদের কার্যক্রম সুস্পষ্টভাবে চালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। এইসব আদর্শিক কার্যক্রম আহলে সুন্নাতের মাঝে যেমন লক্ষ্য করা গিয়েছিল তেমনি শিয়া মাযহাবের অনুসারী মুসলমানদের মাঝেও সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। আহলে সুন্নাতের মধ্যকার ঘটনা প্রবাহের মধ্যে কাবুলে সংঘটিত ‘মুসলমান তরুণদের’ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়। এই আন্দোলনের কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন ‘গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার’, আহমাদ শাহ মাসুদ এবং তাঁদের শিক্ষক ‘বোরহান উদ্দিন রাব্বানী, সেবগাতুল্লা মাজাদ্দেদি প্রমুখ। শিয়া মাযহাবের অনুসারী মুসলিম ব্যক্তিত্বদের মধ্য থেকেও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়। যেমন সাইয়্যেদ ইসমায়িল বালখি, ওয়ায়েজ মেসবাহ এবং আলি আসগর শুয়া। এই ইসলামী চিন্তাবিদগণের প্রত্যেকেই বিভিন্ন দল, সংস্থা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী জাগরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছেন।

তাঁদের সংগঠিত কয়েকটি আন্দোলন বা সংস্থার নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, হেজবে আরশাদ এবং হেযবে ওয়াতান। এই দুটি দল আফগানিস্তানে বিশেষ করে হেরাত এবং কান্দাহারে মাযহাবি এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে চালিয়েছিল। কান্দাহারে ছাত্র ছাত্রীদের জন্যে ‘মাদ্রাসায়ে এলমিয়ে জাফারিয়া’ প্রতিষ্ঠিত করে বহু সফল ছাত্র সৃষ্টি করেছেন। মুহাম্মাদ আসেফ মোহসেনির হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আঞ্জুমানে সুবহে দনেশ। এইসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ইসলামী জাগরণের ধারা ব্যাপক গতি লাভ করে। এদের মাঝে যুবকদের একটি দল মুহাম্মাদ আসেফ মোহসেনির আদর্শে বিশ্বাসী ছিল না। তাঁরা ইতোমধ্যে ইরানের ইমাম খোমেনী (রহ) এর জীবনাদর্শ ও কর্মের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘হিযবুল্লাহ’র আদর্শিক আন্দোলনের মতো একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনকে অনেকে হিযবুল্লাহ’র আফগান শাখা বলেও মনে করেন।

হেরাতেও যুবকদের একটি দল নতুন একটি আন্দোলন বা সংগঠন গড়ে তুলেছিল। সাইয়্যেদ ইসমায়িল বালখির সহযোগিতায় গড়ে ওঠা ঐ সংস্থাটির প্রাথমিক নাম ছিল ‘মুজতামে ইসলামী’। পরবর্তীকালে অবশ্য এই নামটি আর থাকে নি। নামটি পরিবর্তিত হয়ে ‘হেযবে আরশাদ’ নাম ধারণ করে। খ্রিষ্টীয় ১৯৭১ সালের পর এই সংগঠনটি আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে সর্বপ্রথম তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। ‘রাদে ইসলামী’ নাম নিয়ে তারা তাদের তৎপরতা শুরু করে।

আফগানিস্তানে ইসলামী জাগরণের উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সেটা হলো আফগানিস্তানের আশেপাশের দেশগুলোতে বিভিন্ন রকম জ্ঞান অর্জনের জন্যে ছাত্ররা যেত এবং সেখানে পড়ালেখা শেষ করে ফিরে আসতো। বর্তমান আফগানিস্তানে মোঙ্গলদের আক্রমণের আগে অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় তেরো শতকে অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিল। আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে এগুলো গড়ে ওঠে। তবে মোঙ্গলদের পাশবিক হামলার ফলে সেইসব মাদ্রাসা ধ্বংস হয়ে যায়। মাদ্রাসাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে বাধ্য হয়ে আফগান যুবকরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জ্ঞান অর্জন করতে চলে যায়। বিশেষ করে বোখারা, ভারত, মিশর, ইরান এবং ইরাকেই গিয়েছিল বেশি। বিগত অর্ধ শতাব্দীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সংখ্যাও কম ছিল না। 

এঁদের মাঝে বোরহান উদ্দিন রাব্বানীসহ আরো অনেকেই ছিলেন। তাঁরা মিশরের বিখ্যাত সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শের সাথে পরিচিতি লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সে কারণে তাঁরা আফগানিস্তানে ফিরে আসার পর মুসলিম যুবকদের সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইতোমধ্যে অনেক আবার ইরানের কোমেও পড়ালেখা করেছেন। কোমে ধর্মতত্ত্ব চর্চার কাজ শেষ করে দেশে ফিরে গিয়ে ইসলামী জাগরণ তথা আফগানিস্তানের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন। যেহেতু তাঁরা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ) এর আদর্শের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিতি লাভ করতে পেরেছিলেন সে কারণে আফগানিস্তানে ফিরে গিয়ে তাঁরা সেই আদর্শকে কাজে লাগিয়েছেন। সেজন্যেই সমকালীন আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে নতুন নতুন অনেক ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে।  

তবে আফগানিস্তানে বাম রাজনীতিরও চর্চা হয়েছিল। সাংবিধানিক স্বাধীনতা চর্চার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা মার্কসবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছিল। নুর মুহাম্মাদ তারেকি’র নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি’ আর ‘নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’ গড়ে উঠেছিল ডক্টর আব্দুর রাহিম মাহমুদি’র নেতৃত্বে। এইসব বামপন্থী রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার ফলে মুসলিম চিন্তাবিদগণ মারাত্মক সমস্যার মুখে -বলা যায়-তাঁরা অশনি সংকেতের মুখে পড়ে যান। এই বিপদ উপলব্ধি করার ফলেই ‘মুসলিম যুব আন্দোলনে’র মতো সংগঠন গড়ে উঠেছিল যারা লক্ষণীয় পর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মার্ক্সিস্ট আন্দোলনের বিকাশ এবং সরকারের সাথে তাদের সহযোগিতার ঘটনা সেইসাথে মুহাম্মাদ দাউদ খানের অভ্যুত্থান ইত্যাদির কারণে ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে একরকম নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। এছাড়া ১৯৭৮ সালে মার্ক্সিস্টদের অভ্যুত্থান এবং ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা আফগানিস্তান দখল করার ফলে ইসলামী দলগুলো আবারো নিজেদেরকে সংগঠিত করার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১১

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন