সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮ ১৭:২৬ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার:  কেরমান জামে মসজিদ

কেরমান জামে মসজিদ বা মোজাফফারি জামে মসজিদ এখানকার আরো বহু দর্শনীয় স্থাপনার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।

 ইরানের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে গর্ব করার মতো একটি স্থাপনা হিসেবে পরিগণিত এই মসজিদ। পবিত্র এই স্থানে শিল্পেরা এমনভাবে হাতে হাত রেখে পরস্পরকে সম্পৃক্ত করে রেখেছে যে সেগুলো সে সময়কার শিল্পীদের সৃজনশীলতা তাঁদের চিন্তা চেতনা, নান্দনিকতার উৎকর্ষেরই প্রমাণ বহন করে। এগুলো এতো বেশি প্রশংসনীয় যে আপনি দেখামাত্রই অবাক হবেন। অতি সূক্ষ্ম টাইলসের কারুকাজ দেখামাত্র আপনাকে হতবাক করে দেবে। মসজিদের আকাশচুম্বী সুদর্শন মিনার যেমন হা করে তাকিয়ে দেখার মতো তেমনি অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন লক্ষ্য করা যাবে মসজিদের শাবেস্তানেও।

৭৫০ হিজরিতে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদটি নির্মাতার নাম ইতিহাসে পাওয়া গেছে ‘আমির মোবারেয উদ্দিন মুহাম্মদ মোজাফফার’। ইতিহাসে আরো পাওয়া গেছে এই মসজিদটি যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন তার অবস্থান ছিল কেরমান শহরের বাইরে। কিন্তু কালক্রমে শহরের পরিধি বেড়ে যাবার ফলে শহরের ভেতরে পড়ে গেছে মসজিদটি। মসজিদটির আকৃতি চারটি ঝুল বারান্দা সম্পন্ন। মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বার চমৎকার সব কারুকার্য খচিত। টাইলসের সুনিপুণ কাজগুলো যেমন চোখ ধাঁধানো তেমনি ঐতিহাসিক অনেক লিপিকর্মও এই স্থাপনাটিকে দিয়ে বাড়তি মর্যাদা। পুরো কেরমান শহরের মধ্যে এই মসজিদটি তাই একটি ঐতিহাসিক মূল্যবোধ সম্পন্ন স্থাপনার নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ করে মসজিদের ভেতরে মেহরাবের কাজগুলো অসাধারণ। মেহরাবে মর্মর পাথরের ওপর পবিত্র কুরআনের আয়াত এতো সুন্দর করে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে যে যিনিই দেখবেন ভালো না লেগে পারবে না। আয়াতের ক্যালিগ্রাফির পাশে আয়নার মতো ঝকমকে টাইলসের ব্যবহারও দেখার মতো। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ইতিহাসের বিভিন্ন যুগপর্বে মসজিদের বিভিন্ন অংশ মেরামত যেমন করা হয়েছে তেমনি কোনো কোনো অংশে পরিবর্তনও করা হয়েছে।

জাবালিয়া গম্বুজ কেরমান শহরের আরেকটি দর্শনীয় স্থাপনা। সমগ্র ইরানের স্থাপত্য শিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোর তালিকায় এই গম্বুজটির নামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় এই গম্বুজটির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কেল্লা দোখতার পাহাড়ের ওপর এই গম্বুজটি নির্মাণ করা হয়েছে। গম্বুজটির আকার আকৃতি থেকে উফরব্ধি করা যায় যে এটি ছিল সাসানীয় শাসনামলের অগ্নিমন্দির। জাবালিয়া গম্বুজটি আট কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা। গম্বুজের উচ্চতা হলো বিশ মিটার। গম্বুজের ছাদটি ইটের তৈরি। দেয়ালগুলোতে পাথর এবং চকের মিশ্রণ সহজেই লক্ষ্য করা। ২০০৪ সালে ব্যাপক পুনর্গঠন এবং পুনর্নির্মাণের পর এই স্থাপনাটিকে ঐতিহাসিক প্রস্তর লিপির যাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। কেরমানে আবিষ্কৃত সবচেয়ে ছোটো সমাধি পাথরের নিদর্শনটিও এই যাদুঘরে রাখা আছে।

কেরমান শহরে সুন্দর সুন্দর অনেক বাগ বাগিচা আছে। এই বাগিচাগুলোর মাঝে ‘হারান্দি’ বাগিচাটির খ্যাতি একটু বেশি। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। কারণটা হলো ঐতিহাসিক দুটি মিউজিয়াম রয়েছে এই বাগিচাটির ভেতরে। একটি হলো ‘পুরাতত্ত্ব’ যাদুঘর এবং অপরটি ‘বাদ্যযন্ত্র’ যাদুঘর। কেরমানের জনগণের জন্যে এই যাদুঘরটি যথেষ্ট গর্বের।কেননা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং সংগীত ও বাদ্য বাজনার প্রতি তাদের আকর্ষণ যে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিল এগুলো সেই সমৃদ্ধ অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং যারাই এই যাদুঘর দেখতে আসেন তাদেরকে সগর্বে তা জানান দেয়।

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই যাদুঘরটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের নিদর্শনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইরানে যতগুলো মিউজিয়াম পার্ক রয়েছে সেগুলোর মাঝে এই হারান্দি পার্কটির একটা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এর কারণ দুটো। একটা হলো উপযোগী পরিবেশ এবং স্থাপত্য শৈলীগত অনন্য বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে হারান্দি বাগিচা ভবনের নীচতলাকে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের যাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আর প্রথম তলাটিকে বানানো হয়েছে পুরাতত্ত্ব যাদুঘর।  এই যাদুঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে কেরমান প্রদেশের প্রাচীন সভ্যতার সাথে পরিচয় করানো এবং ঐতিহাসিক এ অঞ্চলের সাথে সভ্যতার ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তোলা।

বাগে হারান্দি পুরাতাত্ত্বিক যাদুঘরে হালিলরুদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। অসম্ভব সুন্দর ডিজাইন এবং নকশার মাটির তৈজস বা শো-পিস শোভা পাচ্ছে এই যাদুঘরে। আনুমানিক ৫ হাজার বছর আগের বলে বিশেষজ্ঞগণ মত দিয়েছেন। জযমুরিয়ানদের ঐতিহাসিক অঙ্গনের বেশ কিছু নিদর্শন এই যাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। এগুলো হাখামানেশীয়দের সময়কার। মৃৎ শিল্পের সমৃদ্ধ একটি ভাণ্ডার বলা চলে এ যুগের শিল্পকর্মগুলোকে। মাটির পানপাত্র, কাপ, খাবার প্লেট, পানি রাখার পাত্র, বিশেষ করে কোমকোমেহ অর্থাৎ কোনো সফরে যাবার সময় ছোট্ট কোনো পাত্রে পানি মজুদ করার ব্যবস্থা করা হতো যেগুলো দিয়ে, সে ধরনের পানির পাত্র, এগুলোর বৈশিষ্ট্যটা হলো মুখ বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থা ছিল পাত্রগুলোর।

আরো রয়েছে মাটির তৈরি রেইতুন বা পানি রাখার ভিন্ন ধরনের আরেক পাত্র। বিভিন্ন পশুর মাথার ডিজাইনের সাথে পানপাত্রটি রাখার ব্যবস্থা করে এই পাত্রটি তৈরি করা হয়। সাধারণত ঘোড়া, সিংহ, গরু কিংবা বড়ো শিংযুক্ত মাথার মেষ ইত্যাদি। বিভিন্ন রঙে এগুলোকে সজ্জিত বা নিকেল করা হয়। যার ফলে ঝকঝকে হয়ে ওঠে এগুলো। প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে এগুলো যাদুঘরে যেমন সংরক্ষিত আছে শিল্প রসিক ইরানের জনগণ এগুলোর রেপ্লিকা নিজেদের ঘরেও সাজিয়ে রাখে।

কেরমানের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের যাদুঘরটি ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রাচীন ভায়োলিন, সন্তুর, রবাব, কানুন ইত্যাদি বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র এই যাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। এইসব বাদ্যযন্ত্রের সাথে অমর হয়ে আছে ইয়াহিয়া, নারিমন এবং সাউদের মতো ওস্তাদদের কালজয়ী শিল্পকর্মও। এই মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে যে উদ্দেশ্যটি কাজ করেছিল তাহলো ইরানের স্থানীয় এবং ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের সাথে দর্শকদের পরিচয় করানো এর তার পাশাপাশি ইরানের পার্শ্ববর্তী যেসব দেশের মিউজিকের সাথে ইরানের মিউজিকের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সময় সুযোগ-মতো আপনারাও এগুলো দেখে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে ভুলবেন না এ প্রত্যাশায় পরিসমাপ্তি টানছি।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৫

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ