অক্টোবর ১৩, ২০১৮ ১৯:০১ Asia/Dhaka

আজকের আসরে আমরা মসজিদ নির্মাণের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি মালয়েশিয়ার কয়েকটি মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।

মালয়েশিয়ার ক্রিস্টাল দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

মুসলিম জীবনে মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামে মসজিদ নির্মাণকে একটি উত্তম কাজ হিসেবে বর্ণনা করে বলা হয়েছে এজন্য আল্লাহর দরবারে অসীম পুরস্কার রয়েছে। তবে এখানে মসজিদ নির্মাণ বলতে মসজিদ আবাদ করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মসজিদের অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে মসজিদে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অন্য কথায়, মসজিদ নির্মাণের আগে সেখানে কারা নামাজ পড়বে, কারা সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করবে এবং কারা মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে সেইসব মানুষ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সূরা তওবার ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মসজিদ আবাদকারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন এভাবে:

মালয়েশিয়ার ক্রিস্টাল দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

“নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি এবং কায়েম করেছে নামায ও আদায় করে যাকাত;আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করে না। অতএব,আশা করা যায়,তারা হেদায়েত প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।”

কুয়ালালামপুর জামে মসজিদ

আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এর আগের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদেরকে মসজিদ আবাদ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। সেখানে তিনি মুশরিকদেরকে এই মহান ও পবিত্র কাজের অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। কাজেই পবিত্র কুরআনে মসজিদ আবাদকারীদের যে বৈশিষ্ট্য ঘোষণা করা হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, মসজিদ আবাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দু’টি দিক রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে মসজিদ আবাদকারী ব্যক্তিদের হতে হবে পূণ্যবান ও সালেহ বান্দা এবং তাহলেই কেবল সামাজিকভাবে মুসল্লিরা এ মসজিদের সুফল ভোগ করতে পারবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মসজিদ কে বা কারা নির্মাণ করছে সেটি মসজিদ নির্মাণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কুয়ালালামপুর জামে মসজিদ

মসজিদ আবাদ সম্পর্কে হাদিসে যেসব বর্ণনা এসেছে তা থেকেও আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, মসজিদ হচ্ছে এমন একটি স্থান যেটি মানুষকে দুনিয়ার চাকচিক্য থেকে দূর করে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।  এ ছাড়া, এই পবিত্র ঘর আখেরাতের জীবনকে দুনিয়ার জীবনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে মানুষকে উৎসাহিত করে। দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি আকর্ষণ মসজিদের সঙ্গে খাপ খায় না। ইমাম আলী (আ.) কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে বলেছেন, তখনই কিয়ামত সংঘটিত হবে যখন মানুষের মধ্যে ইসলামের নাম ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না এবং কুরআনের কোনো শিক্ষাও মানুষের জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে সময় অবকাঠামোগত দিক দিয়ে মসজিদের অভাব থাকবে না কিন্তু সেখান থেকে হেদায়েত অর্জনের দিক থেকে মসজিদগুলো থাকবে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত।”

কুয়ালালামপুর জামে মসজিদ

ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এ সম্পর্কে বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সেইসব মসজিদ আল্লাহ তায়ালার কাছে নালিশ জানাবে যেসব মসজিদে আশপাশের মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে না।” কাজেই বোঝা যাচ্ছে, মসজিদে নামাজ আদায় না করার অর্থ হচ্ছে মসজিদকে ধ্বংস করে ফেলা। অন্যদিকে মসজিদ আবাদ করার অর্থ হচ্ছে, স্বতস্ফুর্তভাবে মসজিদে মুসল্লিদের উপস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের আনাগোনায় মসজিদ মুখরিত থাকা। সুতরাং যেসব মসজিদের বাহ্যিক চাকচিক্য অনেক বেশি কিন্তু সেখানে নামাজের ওয়াক্তে কোনো মুসল্লি খুঁজে পাওয়া যায় না আল্লাহ তায়ালার কাছে সেসব মসজিদের কোনো মূল্য নেই। পক্ষান্তরে অতি সাদামাটাভাবে নির্মিত মসজিদ যদি মুসল্লিদের নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতে মুখরিত থাকে তবে সে মসজিদ আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়।

পুত্রজয়া জামে মসজিদ

প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ইসলামি চিন্তাবিদ ইব্রাহিম আল-জান্নাতির লেখা একটি বইয়ে বলা হয়েছে, “...মসজিদ অহংকার করার মতো কোনো প্রাসাদ নয় বরং এটি একান্তমনে ও একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও তার কাছে মুনাজাত ও কান্নাকাটি করার স্থান। আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে মসজিদকে জীবন্ত রাখা, মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা এবং তাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে আহ্বান করার ওপর মসজিদের গুণ ও মান নির্ভর করে; এটির বাহ্যিক চাকচিক্য ও সুউচ্চ মিনারের ওপর নয়। এ কারণে বর্তমান যুগে কে কতো সুন্দর ও জৌলুসপূর্ণ মসজিদ নির্মাণ করতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হলেও মসজিদের প্রকৃত কাজের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।  বিশ্বনবী (সা.)’র যুগে অবকাঠামোগত দিক দিকে কোনো মসজিদেরই বাহ্যিক চাকচিক্য ছিল না। কিন্তু মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিমে হেদায়েতের দিক দিয়ে সেসব মসজিদের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে।

পুত্রজয়া জামে মসজিদ

আসরে এ পর্যায়ে আপনাদেরকে মালয়েশিয়ার কয়েকটি মসজিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। কুয়ালালামপুর জামে মসজিদ মালয়েশিয়ার অন্যতম বড় ও পুরনো মসজিদ। ১৯০৭ সালে এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯০৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সুলতান সেলাঙ্গুর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন। সে সময়কার বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পী আর্থার বেনিসন হ্যাবক মুসলিম স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে এই মসজিদের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন। মসজিদের প্রবেশপথেই স্থাপন করা হয়েছে কংক্রিটের তৈরি  কিছু ছোট ছোট ছাতা। এ ধরনের ছাতা ভারতের উত্তরাঞ্চলে মোঘলদের শাসনামলে নির্মিত মসজিদগুলোতে দেখা যায়। কুয়ালালামপুর জামে মসজিদে লাল ও সাদা রঙের দু’টি মিনার রয়েছে যেগুলোর প্রতিটির উচ্চতা ২৬ দশমিক ৮ মিটার করে। এই মিনার দু’টির শীর্ষদেশও ছাতার আকৃতিতে তৈরি করা হয়েছে।  মিনারের এই অনন্য বৈশিষ্ট্য এই মসজিদকে অন্যান্য মসজিদ থেকে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। এই মসজিদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ যেগুলোর সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা ২১ দশমিক ৩ মিটার। ১৯৯০ সালে এই গম্বুজটি ভেঙে পড়ার পর সেটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। জুমার নামাজে এই মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় জামাতের নামাজ মসজিদের আশপাশের সড়কগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

জামে মসজিদ

মালয়েশিয়ার আরেকটি সুন্দর মসজিদের নাম পুত্রজয়া জামে মসজিদ। ১৯৯৭ সালে এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং দুই বছর পর এর দরজা মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের জন্য খুলে দেয়া হয়। ১৫ হাজার মুসল্লির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই মসজিদকে মালয়েশিয়ার অন্যতম আধুনিক মসজিদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে পুত্রজয়া জামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। ইরানি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য যে সেতুটি পার হতে হয় সেটিকে ইরানের ইস্পাহান নগরীর ঐতিহাসিক খাজু ব্রিজের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে।  মূলত ইরানে সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।

 জামে মসজিদ

মালয়েশিয়ার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ হচ্ছে ক্রিস্টাল মসজিদ। মসজিদটির নির্মাণকাজ ২০০৬ সালে শুরু হয় এবং ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। খাঁটি ক্রিস্টাল দিয়ে নির্মিত মসজিদটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অবস্থিত এস্তেকলাল মসজিদ। ক্রিস্টাল মসজিদে একসঙ্গে ২৫ হাজার মানুষ জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন।  দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মসজিদটি পরিদর্শনের জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। ক্রিস্টাল মসজিদের একটি বড় অসুবিধা হলো বাইরে থেকে এর ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। অথচ মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একান্তে সম্পর্ক স্থাপনের স্থান। কিন্তু সে দিকটিকে উপেক্ষা করে মূলত পর্যটক আকর্ষণকে সামনে রেখে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৩

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ